উদরাময় বা ডায়রিয়া (Diarrhoea)
পশু স্বাভাবিকের চেয়ে ঘনঘন পাতলা পায়খানা করলে তাকে উদরাময় বা ডায়রিয়া (Diarrhoea) বলে। উদরাময় অপেক্ষা ডায়রিয়া কথাটিই আমাদের দেশে বেশি প্রচলিত। ডায়রিয়া প্রধানত বিভিন্নব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও পরজীবীজনিত রোগের লক্ষণ হিসেবে দেখা দেয়। সংক্রমণ ছাড়াও খাদ্যজনিত কারণেও ডায়রিয়া দেখা দিতে পারে। গবাদিপশুর ডায়রিয়া সৃষ্টিকারী কিছু গুরুত্বপুর্ণ রোগ সম্মন্ধে এ পাঠে আলোচনা করা হয়েছে।
নিম্নলিখিত গুণের ব্যাকটেরিয়াগুলো প্রধানত পশুর ডায়রিয়ার জন্য দায়ী। যথা−
♦ Escherichia (ইস্কেরিশিয়া)
♦ Salmonella (সালমোনেলা)
♦ Mycobacterium (মাইকোব্যাকটেরিয়াম)
♦ Pseudomonas (সিউডোমোনাস)
♦ Proteus (প্রোটিয়াস)
♦ Pasteurella (পাস্চুরেলা)
এসব ব্যকটেরিয়ার মধ্যে ইস্কেরিশিয়া, সালমোনেলা ও ইকো ব্যাকটেরিয়াম অধিক গুরুত্বপুর্ণ।
কলিবেসিলোসিস (Collibacillosis)
কলিব্যাসিলোসিস রোগকে বাছুরের সাদা পায়খানা বা সাদা বাহ্য (ঈধষভ উরধৎৎযড়বধ ড়ৎ ডযরঃবঝপড়ঁৎ) বলা হয়। Escherichia coli (ইস্কেরিশিয়া কলাই) নামক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে এ রোগ সৃষ্টি হয়। এ রোগ প্রধানত নবজাতক পশুতে দেখা যায়। মাতৃগর্ভের জীবাণুমুক্ত পরিবেশ থেকে ভু‚মিষ্ট হবার পর নবজাতক বাছুর বিভিন্ন রোগজীবাণুর সংস্পর্শে আসে। এসব জীবাণু প্রধানত নাভিরজ্জু, শ্বাসনালি এবং খাদ্যের সাথে শরীরে প্রবেশ করে। নবজাতকের অভ্যন্তরীণ রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার ভারসাম্যের ওপর রোগ সৃষ্টি হওয়া নির্ভর করে। জন্মের পর শালদুধ গ্রহণের মাধ্যমে এ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু কুসংস্কারজনিত কারণে নবজাতক বাছুর শালদুধ থেকে বঞ্চিত হলে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং বিভিন্ন রোগের প্রতি সহজেই সংবেদনশীল হয়। নবজাতক বাছুর জন্মের ৩ দিনের মধ্যেই কলিব্যাসিলোসিস রোগে আক্রান্ত হতে পারে। আক্রান্ত বাছুরের মৃত্যুর হার ৫০% পর্যন্ত হতে পারে।
রোগলক্ষণঃ
কলিব্যাসিলোসিস প্রধানত দুপ্রকৃতির হয়ে থাকে। যথা− সেপ্টিসেমিক ও এন্টারোটক্সিক।
সেপ্টিসেমিক প্রকৃতি (Septicemic Type)ঃ জন্মের ৪ দিনের মধ্যে এ রোগ হয়। জীবাণু অতি দ্রুত রক্ত প্রবাহে প্রবেশ করে এবং টক্সিমিয়া (Toxaemia) তৈরি করে। আক্রান্ত বাছুর লক্ষণ প্রকাশের ৯৬ ঘন্টার মধ্যে মারা যায়। মৃত্যুর পুর্বে ক্ষুধামন্দা, দুর্বলতা, ডায়রিয়া প্রভৃতি দেখা দেয়।
এন্টারোটক্সিক প্রকৃতি (Enterotoxic Type)ঃ অনুর্ধ ৫ দিনের বাছুরে এ রোগ হয়। এতে বাছুর দুর্বল হয়, দৈহিক তাপমাত্রা হ্রাস পায় এবং ঝিলি আবরণী ফ্যাকাশে হয়ে যায়। নাড়ির গতি শ্লথ ও
অসমন্তি হয়, মৃদু খিঁচুনি ও শ্বাসহীনতা দেখা দেয়। তরল পদার্থ জমার কারণে পেট ফুলে যায়, পাতলা পায়খানা দেখা দেয় এবং ২−৬ ঘন্টার মধ্যে মারা যায়।
পায়খানার রঙ ফ্যাকাসে হলুদ অথবা সাদাটে হয়। মলে গ্যাস থাকলে ফেনা ফেনা দেখা যায়। লেজ এবং মলদ্বারের চারদিকে পায়খানা মেখে যায়। তাই এ রোগকে বাছুরের সাদা বাহ্য বা হোয়াইট স্কাউরও (White Scour)বলা হয়। অনেক সময় পায়খানার সাথে রক্ত থাকতে পারে এবং পায়খানা অত্যন্ত দুর্গন্ধযুক্ত হয়। লেজ ও পশ্চাদদেশ সর্বদা ময়লাযুক্ত থাকে এবং বাছুর গাভীর ওলান থেকে দুধ পান করে না।
রোগ নির্ণয়
লক্ষণ দেখে রোগ সম্বন্ধে ধারণা করা যায়। তবে চ ড়াš ভাবে রোগ নির্ণয়ের জন্য আক্রাš বাছুর
থেকে সংগৃহীত নমুনা পরীক্ষা করে Escherichia coli জীবাণু শণাক্ত করা প্রয়োজন।
চিকিৎসাঃ
নিম্নলিখিতভাবে এ রোগের চিকিৎসা করা হয়। যথা−
খাদ্য পরিবর্তন ঃ দুধ পান করানো বন্ধ করে দিতে হবে। দুধের পরিবর্তে ৫% ডেক্সট্রোজ স্যালাইন মুখদিয়ে পান করাতে হবে।
ফ্লুইড ও ইলেকট্রোলাইট প্রয়োগ ঃ সোডিয়াম বাইকার্বনেট ও ডেক্সট্রোজ ইনজেকশন দেয়া অত্যন্ত ফলপ্রসু। ডায়রিয়ার ফলে তীব্র পানিস্বল্পতা দেখা দিলে প্রথম ৪−৬ ঘন্টা প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ১০০ মি.লি. এবং পরবর্তী ২০ ঘন্টা ১৪০ মি.লি. হারে প্রয়োগ করতে হবে।
জীবাণুদমনকারী ওষুধ প্রয়োগ ঃ প্রধানত সালফাডায়াজিন, সালফাডিমিডিন, সালফাপাইরিডিন এবং স্ট্রেপটোমাইসিন সালফেট দ্বারা তৈরি ওষুধ এ রোগের চিকিৎসার জন্য খুবই কার্যকর। বর্তমানে
বাজারে স্ট্রিনাসিন ট্যাবলেট নামে এ ওষুধ পাওয়া যায়। প্রতি ৪০ কেজি দৈহিক ওজনের জন্য দৈনিক ৫ গ্রাম ট্যাবলেটই যথেষ্ট। চিকিৎসার মেয়াদ ৩ দিন।
রোগ নিয়ন্ত্রনঃ
♦ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যকর ঘরে বাচচা প্রসবের ব্যবস্থা করতে হবে।
♦ মলদ্বারের চারপাশ ও ওলান প্রসবের পুর্বে ভালোভাবে পরিষ্কার রাখতে হবে।
♦ জন্মের পরপরই নবজাতকের নাভিরজ্জু ২% আয়োডিন দ্বারা পরিষ্কার করতে হবে এবং নাভি পেটের সমান করে সুতো দিয়ে বেঁধে দিতে হবে।
♦ আক্রান্ত বাছুরকে পৃথক স্থানে রেখে চিকিৎসা করাতে হবে।
♦ জন্মের পরপরই বাছুরকে পর্যাপ্ত শালদুধ পান করানো নিশ্চিত করতে হবে। বাছুর নিজে পান না করতে পারলে ওলান থেকে দুধ সংগ্রহ করে বোতল অথবা স্টমাক টিউব দিয়ে পান করাতে হবে।
♦ প্রসবের তিন সপ্তাহ পুর্বে গাভী অথবা নবজাতক বাছুরে এ রোগের বিরুদ্ধে প্রতিষেধক প্রয়োগ করতে হবে।
সালমোনেলোসিস (Salmonella)
এটি একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ। Salmonella typhimurium (সালমোনেলা টাইফিমুরিয়াম) Salmonella dublin (সালমোনেলা ডাবলিন) ও Salmonella neuport (সালমোনেলা নিউপোর্ট) নামক তিনটি ব্যাকটেরিয়া গরুমহিষে এ রোগ সৃষ্টি করে। অন্যান্য গবাদিপশুও সালমোনেলা গ্রুপের জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হতে পারে। এসব জীবাণু দ্বারা সৃষ্ট রোগকে সালমোনেলোসিস বলা হয়।
প্রধানত বাছুর এবং অন্যান্য বাচচা প্রাণীর জন্মের প্রথম কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এ রোগ হয়ে থাকে।
জীবাণু সংক্রমণ
খাদ্য অথবা মলের মাধ্যমে জীবাণু সংক্রমিত হয়। অনেক সময় জীবাণু বহনকারী বয়স্ক পশুর মাধ্যমে রোগজীবাণু বাছুরে সংক্রমিত হতে পারে। একবার সংক্রমণ দেখা দিলে খুব তাড়াতাড়ি রোগ ছড়িয়ে পড়ে।
রোগলক্ষণঃ
♦ শরীরের তাপমাত্রা ৪১.১ক্ক সে. (১০৬ক্ক ফা.) পর্যন্ত উঠতে পারে।
♦ আক্রান্ত পশুতে তীব্র ও দীর্ঘমেয়াদী অš প্রদাহ দেখা দেয়। তীব্র প্রকৃতির অন্ত্রপ্রদাহে দৈহিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং দুর্গন্ধযুক্ত ডায়রিয়া হয়। পায়খানার সাথে শ্লেষ্মা ও রক্ত থাকতে পারে।
♦ পরবর্তীতে দৈহিক তাপমাত্রা হ্রাস পেতে পারে এবং পানিস্বল্পতা দেখা দেয়।ব্যাকটেরিয়াজনিত বিষক্রিয়া এবং পানিস্বল্পতার কারণে আক্রান্ত পশুর শতকরা ৭৫ ভাগ কয়েকদিনের মধ্যেই মারা যায়।
রোগ নির্ণয়ঃ
লক্ষণ ও আক্রান্ত পশু থেকে সংগৃহীত নমুনা পরীক্ষা করে রোগ নির্ণয় করা যায়।
চিকিৎসাঃ
♦ আক্রমণকারী ব্যাকটেরিয়া দমনের লক্ষ্যে প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ২০ মিলিগ্রাম ক্লোরামফেনিকল ৬−১২ ঘন্টা পরপর ৩ দিন ইনজেকশন আকারে দিতে হবে।
♦ অন্ত্র প্রদাহের জন্য প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ২০ মিলিগ্রাম নাইট্রোফিউরাজোন ৫ দিন পর্যন্ত খাওয়াতে হবে।
♦ ডায়রিয়া বন্ধের জন্য অ্যাসট্রিনজেন্ট (Astringent) ওষুধ খাওয়াতে হবে।
♦ ডায়রিয়াজনিত পানিস্বল্পতা প্রতিরোধ করার জন্য সাধারণ বা ডেক্সট্রোজ স্যালাইন ইনজেকশন দেয়া যেতে পারে।
♦ দৈহিক তাপমাত্রা বেশি থাকলে ৫% সোডিয়াম বাইকার্বনেট শিরায় ইনজেকশন দেয়া হলে উপকার পাওয়া যায়।
নিয়ন্ত্রণঃ
♦ আক্রাš পশুকে পৃথক স্থানে রেখে চিকিৎসা করতে হবে।
♦ গোশালা পরিষ্কার-পরিচছন্ন ও জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে।
♦ প্রতিষেধক টিকা ব্যবহার করা যেতে পারে।
♦ নবজাতক বাছুরে পর্যাপ্ত শালদুধ পান করাতে হবে।
জোনস্ ডিজিজ (Johne’s Disease)
Mycobacterium paratuberculosis (মাইকোব্যাকটেরিয়াম প্যারাটিউবারকুলোসিস) নামক ব্যাকটেরিয়া এ রোগ সৃষ্টি করে। আক্রাš পশুতে তীব্র অš প্রদাহ দেখা দেয় এবং এ কারণে দীর্ঘমেয়াদী ডায়রিয়া হয়। ডায়রিয়াজনিত কারণে পানিস্বল্পতা দেখা দেয়, দৈহিক ওজন হ্রাস পায়,গরু হাড্ডিসার হয়ে যায় এবং অবশেষে দুর্বলতার কারণে মারা যায়।
চিকিৎসাঃ
♦ প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য ৫০ মিলিগ্রাম স্ট্রেপ্টোমাইসিন ৬ ঘন্টা পরপর খাওয়ানো যেতে পারে।
♦ ৫০০ মিলিগ্রাম ডাই-হাইড্রস্ট্রেপ্টোমাইসিন পেশিতে ইনজেকশন দেয়া যেতে পারে।
এম এ ইসলাম
Please follow and like us: