এপিডিমোলজিঃ
এগ ড্রপ সিনড্রোম ৭৬ (ইডিএস ৭৬) মুরগীর ভাইরাসজনিত রোগ।এই রোগে মুরগি আক্রান্ত হলে হঠাৎ করে মুরগির ডিম কমে যায় এবং কোনো সময় ডিম উৎপাদন স্বাভাবিক পর্যায়ে উঠেনা।ডিমের গুণগত মান কমে যায় এবং ডিমের খোসার স্বাভাবিক রং হয় না।
এই রোগের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে খোসা বিহীন ও নরম খোসাযুক্ত ডিম পাড়া ।
১৯৭৬ সনে Van Eck নর্দান আয়ারল্যান্ডে সর্বপ্রথম মুরগীর এগ ড্রপ সিনড্রোম সনাক্ত হয়।মুরগি যখন পিক প্রডাকশনে থাকে তখন এই রোগটি আক্রমণ করে।
এজেন্টঃ
এ রোগের কারণ এভিয়ান এডিনো ভাইরাস (Avian adeno virus)গোত্রভুক্ত ইডিএস ৭৬ ভাইরাস।এটি ডাবল স্ট্যান্ডাড ডি এন এ ভাইরাস এবং এর স্ট্রেইন হচ্ছে বি সি ১৪ এবং ১২৭।এগ ড্রপ সিনড্রোম হাঁসের এডিনো ভাইরাস দ্বারা সংক্রামিত হয়।
এটি ডিএনএ ভাইরাস।
এটি ভ্রণের এলানটোইক (allantoic)ফ্লুইডে এই ভাইরাস জন্মায় কিন্তু মুরগীর দেহের কোনো অংশে জন্মায় না।এটি খুব রেজিস্টেন্ট যেমন পি এইচ ৩-১০ এবং ৫৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেট তাপমাত্রায় ৩ ঘন্টা বেচে থাকে।এটি ইথার ও ক্লোরোফর্মে রেজিস্ট্যান্টকিন্তু ০.৫ % ফরমাল্ডিহাইড ও গ্লুটারাল্ডিহাইডে মারা যায়।
এর জেনাস হচ্ছে Aviadeno virus এবংফ্যামিলি হচ্ছে এডিনোভিরিডি।।এই জেনাসে কয়েকটি গ্রুপে বিভক্তঃ
গ্রুপ ১। কোয়েল ব্রংকাটিস ভাইরাস ২।হেমোরেজিক এন্টারাইটিস ভাইরাস.মার্বল স্প্লিন ডিজিজ ভাইরাস
৩।এগ ড্রপ সিন্ড্রম ভাইরাস কিন্তু এর সেরোটাইপ মাত্র ১ টি।
হোস্টঃ
সুপ্তিকালঃ
এগ ড্রপ সিনড্রোমের সুপ্তিকাল মুরগী ও কোয়েলের ক্ষেত্রে খুবই পার্থক্য হয়ে থাকে।ইনকিউবেশন পিরিয়ড ভ্যারিয়েবল।ব্রয়লার ব্রীডার,বাদামী লেয়ার এবং জাপানী কোয়েল বেশি আক্রান্ত হয়।এগ ড্রপ রোগে মুরগীর শারীরিক অসুস্থতার লক্ষণ প্রকাশ পায় না।ফলে মুরগী শারীরিকভাবে সুস্থ দেখায়। এতে খামারের অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধিত হয়।২৪-৪১ সপ্তাহে দিকে বেশি হয়।তবে যে কোন বয়সে আক্রান্ত হতে পারে
হাঁস এডিনো ভাইরাসের প্রাকৃতিক বাহক।মুরগী,কোয়েল,কবুতর ইত্যাদি এই রোগে আক্রান্ত হয়।হাঁস ও রাজহাঁস এগ ড্রপ সিনড্রোম রোগে আক্রান্ত হয় না কিন্তু এরা এ রোগের ভাইরাস বহন করে।
রাজহাঁসের বাচ্চা এই রোগে আক্রান্ত হয়।বিশ্বের প্রায় সব দেশে ডাক এডিনোভাইরাস রোগের প্রাদুর্ভাব আছে।এগ ড্রপ সিনড্রোম ইউরোপ,এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকায় দেখা যায়, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় এ রোগ দেখা যায় না।
রোগ কিভাবে ছড়ায়ঃ
ই ডি এস রোগের ভাইরাস তিন ভাবে বিস্তার লাভ করে।
(১) ক্লাসিকেল (VerticalTransmision): আক্রান্ত মুরগীর ডিমের মাধ্যমে বাচ্চাতে সংক্রামিত হয় এবং ডিমপাড়া্র পর্যন্ত রোগ সুপ্ত অবস্থায় থাকে।
(২) এন্ডেমিক ফর্ম ( horizontal Transmision): ঝাঁক থেকে ঝাঁকে এবং ডিমের ট্রে,ট্রাক থেকে বা বিষ্ঠার মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়।
(৩) বিক্ষিপ্ত ফর্ম (Sporadic Form): হাঁস ও রাজহাঁসেরসংস্পর্শে ও দূষিত পানির মাধ্যমে রোগ বিস্তার লাভ করে।এটি খুব কম হয়।
হরিজোন্টাল (Horizontal) বিস্তারের ক্ষেত্রে
আক্রান্ত মুরগীর ডিম থেকে ডিমপাড়া পর্যন্ত এ রোগ সুপ্ত অবস্থায় থাকে।ভিজিটরের পোষাক,জুতা,রিক্সা,ভ্যান,পিক আপ,খাবারের গাড়ি,ডিমের গাড়ি,খাবার ও পানির পাত্র,ডিমের কেইজ ইত্যাদির মাধ্যমে ছড়ায়।ভার্টিকেল বিস্তারের (Vertical Transmision) ক্ষেত্রে সুপ্তিকাল ৫-১০ সপ্তাহ।
প্যাথোজেনেসিসঃ
ই ডি এস ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করার পর নাসিকার মিউকোসাতে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় এবং ভাইরেমিয়া এর মাধ্যমে লিমফয়েড টিস্যু যেমন প্লীহা (Spleen), থাইমাস্ (Thymus) ও ডিম্বনালীর ইনফান্ডিবুলাম (Infundibulun of oviduct) কে আক্রান্ত করে।এর পর মুরগীর জরায়ুর পাউস অব গ্ল্যান্ডের কোষে বিস্তার লাভ করে।তীব্র (একিউট) ভাইরাসের সংক্রমণে হঠাৎ করে ডিম উৎপাদন কমে যায়।খোসা পাতলা এবং খোসা ছাড়া ডিম পাড়ে এবং (ক্রনিক) পুরাতন সংক্রমণে পুনঃ পুনঃ ডিমপাড়া কমে যায়।
রোগ লক্ষণ
খামারে ই ডি এস রোগে আক্রান্ত মুরগীর হঠাৎ করে ডিম পাড়া কমে যায়।
আক্রান্ত মুরগী খোসাবিহীন,পাতলা ও নরম খোসাযুক্ত ডিম পাড়ে।খাচার নিচে রসগোল্লার মত প্রচুর ডিম পাওয়া যায়।কোন লক্ষণ দেখা যায়না।৫-৫০ % ডিম কমে যায় এমন কি ডিম শূণ্যের কোটায় চলে আসে এবং ২-৪ সপ্তাহে ডিম স্বাভাবিক হয়ে যায়।ডিম স্বাভাবিক হলেও কিছু কিছু মার্বেলের মত ছোট ডিম পাড়ে।ডিম পিক প্রডাকশনে আসেনা।কোন মরটালিটি থাকেনা।যদি পেরিটোনাইটিস হয় তাহলে কিছু মর্টালিটি হয়।ডিমের খোসার স্বাভাবিক রং-এর পরিবর্তন দেখা যায় এবং খসখসে ডিম পাড়ে।
এই রোগে আক্রান্ত মুরগীর কোনো নির্ধারিত রোগ লক্ষণ দেখা যায় না।আক্রান্ত মুরগীর ডিমপাড়া আকষ্মিকভাবে ২০-৫০% হ্রাস পায়।তবে রোগের তীব্রতা ভেদে কমও হতে পারে।
ক্রনিক হলে
দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত ডিমপাড়া মুরগীর ডিমপাড়া বারবার হ্রাস পেতে দেখা যায়।৪-১০ সপ্তাহ পর্যন্ত এই সমস্যা থাকতে পারে এবং এতে ১০-১৬ টা ডিম প্রতি মুরগি থেকে কম আসে।।এ রোগে আক্রান্ত মুরগীর ৪-৬ সপ্তাহ পর ডিম উৎপাদন বাড়তে পারে কিন্তু সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায় না।
পোস্ট মর্টেম লিশন
ই ডি এস রোগে আক্রান্ত মুরগীর শুধুমাত্র জননতন্ত্রে লিশন দেখা যায়।
এট্রোফাইড ডিম্বনালী ও ডিম্বাশয়।
অকার্যকর ডিম্বাশয়,জরায়ুতে ইডিমা ( রস) দেখা যায়।
বিবর্ণ অমসৃন,পাতলা খোসা,নরম খোসা এবং খোসা বিহীন ডিম দেখা যাবে।স্প্লিন কিছুটা বড় হয়ে যায়।
রোগ নির্ণয় :
এইচ আই টেস্ট
এলাইজা
আর টি পি সি আর
ডাইরেক ইমিনোডিফিশন টেস্ট
১। রোগ লক্ষণ দেখে
এ রোগে ডিমের খোসা পাতলা হয়, কোন কোনো সময় খোসা ছাড়া ডিম হয়।ডিম উৎপাদন কমে যায় তবে,ডিমপাড়া মুরগী সুস্থ থাকে রাজহাঁসের বাচ্চার ঝাঁক এডিনোভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হলে বাচ্চার শ্বাসকষ্ট দেখা যাবে।
২। রোগ নির্ণয়( অন্যান্য রোগ থেকে কিভাবে আলাদা কর যায়)
এগ ড্রপ সিনড্রোম ও অন্যান্য সংক্রামক রোগ;
যেমন রাণীক্ষেত,এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা,ইনফেকশাস ব্রংকাইটিস, ইনফেকশাস ল্যারিঙ্গোট্রাকিয়াইটিস,এভিয়ান এনসেফালোমাইলাইটিস,ম্যারেক্স রোগ, এভিয়ান লিকোসিস,সি আর ডি,কলেরা,করাইজা ইত্যাদি কারণে মুরগীর ডিম উৎপাদন কম হয় এবং নিম্ন মানের খোসা যুক্ত বিকৃত আকৃতির ডিম পাড়ে।এগ ড্রপ সিনড্রোম রোগে আক্রান্ত মুরগীর অসুস্থতার কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না।কিন্তু উল্লিখিত অন্যান্য সংক্রামক রোগে মুরগীর অসুস্থতা প্রকাশ পায়।
পুষ্টি ও ব্যবস্থাপনার অভাবে রোগ
পুষ্টির অভাবজনিত রোগ,সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাব ও বিপাকীয় রোগে আক্রান্ত মুরগীর ডিম উৎপাদন কমে যায় এবং মুরগীর স্বাস্থ্যহানি ঘটে।
পুস্টির অভাবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- ভিটামিন ই, বি১২,ভিটামিন ডি,ক্যালসিয়াম,ফসফরাস,সেলিনিয়াম ইত্যাদির অভাব।
সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবেও এ সমস্যা হতে পারে যেমন অপর্যাপ্ত পানি সরবরাহ,অত্যধিক তাপ,আকষ্মিক আলো, হঠাৎ খাদ্য পরিবর্তন,ইত্যাদি কারণে ডিম উৎপাদন কমে কিন্তু সঠিক ব্যবস্থাপনায় ডিম উৎপাদন পুনরায় লক্ষ্য মাত্রায় পৌঁছায়।
কিন্তু ইডিএস রোগে আক্রান্ত মুরগীর থেকে ডিম উৎপাদন কখনও লক্ষ্য মাত্রায় পৌঁছানো সম্ভব হয় না ।
বিপাকীয় রোগ ঃযেমন ফ্যাটি লিভার সিনড্রোম,কীটনাশক ও সালফোনামাইড বিষক্রিয়ায় ডিম উৎপাদন কমে এবং এতে মুরগীর অসুস্থতার লক্ষণ দেখা দেয়।
চিকিৎসা: এগ ড্রপ সিনড্রোম ভাইরাসজনিত রোগ তাই এর কোনো চিকিৎসা নেই।
খাদ্যে ভিটামিন,মিনেরালস ও প্রোটিন বৃদ্ধি করা যায় কিন্তু ইডিএস এ তেমন কোনো কার্যকর ফল পাওয়া যায় না।
প্রতিরোধ ওনিয়ন্ত্রণঃ
ক্ল্যাসিক্যাল ফর্ম:ডিমপাড়া মুরগী থেকে (Vertical Transmision)বন্ধের লক্ষ্যে সুস্থ ঝাঁক থেকে মুরগীর ডিম বা বাচ্চা সংগ্রহ করতে হবে।
এনডেমিক ফর্ম :
ইডিএস (EDS) রোগ আনুভূমিক বিস্তারের ক্ষেত্রে নিম্নরূপ পদক্ষেপ নিতে হবেঃ
(১) জীবনিরাপত্তার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।সেই লক্ষ্যে মুরগীর খামার,ডিমের ট্রে এবং ডিম জীবাণুনাশক দ্বারা পরিষ্কার-
পরিচ্ছন্ন করতে হবে।
(২) আক্রান্ত মুরগির বিষ্ঠা পরিষ্কারের ব্যবস্থা করতে হবে।
(৩) সুস্থ মুরগী থেকে অসুস্থ মুরগীকে আলাদা রাখতে হবে অথবা আক্রান্ত ঝাঁক থেকে সুস্থ ঝাঁককে পৃথক রাখতে হবে।
৪) খামারে কর্মরত লোকজন ও যানবাহন দ্বারা যাতে রোগ ছড়াতে না পারে তার ওপর দৃষ্টি রাখতে হবে।এর জন্য জীবনিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতেহবে।
(৫) খামারে জীবাণুমুক্ত সরঞ্জাম ও সূঁচ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
৬।ডিম পাড়ার ২-৩ সপ্তাহ আগে ই ডি এস টিকা দিতে হবে,টিকা দেয়ার ১-২ ঘন্টা আগে ভ্যাক্সিন ফ্রিজ থেকে বের করে রাখতে হবে এবং নরমাল তাপমাত্রায় আসার পর টিকা দিতে হবে।
টিকা দেয়ার ৪ সপ্তাহ পর এলাইজা য়েস্ট করে টাইটার দেখতে হবে যদি ভাল টাইটার না উঠে তাহলে আবার ৭দিন পর টিকা দিতে হবে।
বিক্ষিপ্ত ফর্ম:
ইডিএস রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য মুরগীকে জলচর পাখি হাঁস ও রাজহাঁস থেকে পৃথক রাখতে হবে।বন্যপাখির সাহচর্যে মুরগীকে আসতে দেয়া যাবে না।
মুরগীকে ক্লোরিনযুক্ত পানি পান করতে দিতে হবে।
টিকা
ইনএকটিভেটেড ভ্যাকসিন ১৬-১৭ সপ্তাহে মাংসে দিতে হবে।