খাদ্য বিষক্রিয়া
Food poisoning
গবাদিপশুর মৃত্যুর আরেক নাম খাদ্যে বিষক্রিয়া (Food poisoning). তীব্র বিষক্রিয়ায় গরুর মৃত্যু অবধারিত।
খামারিদের এই বিষয়ে সঠিক জ্ঞান না থাকার কারনে ও অসাবধানতা বশতঃ গরু বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে থাকে এবং তীব্র ভাবে আক্রান্ত হলে কয়েক ঘন্টার মধ্যে মারা যেতে পারে।
এক কথায় বিষক্রিয়া সর্বদাই মারাত্বক একটি সমস্যা সৃষ্টি করে।
আমাদের দেশে প্রতি বছর বিভিন্ন ভাবে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে অনেক গবাদিপশু মারা যায়।
সচরাচর যেসব কারনে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয় তার বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
নাইট্রেট বিষক্রিয়া
বিষক্রিয়ার মধ্যে যতগুলো কারন রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো নাইট্রেট বিষক্রিয়া।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নাইট্রেট যুক্ত কাচা ঘাস খেয়ে এ সমস্যার সৃষ্টি হয়।
অর্থাৎ অপরিপক্ব ও বেশি পরিমানে ঘাস যেমন হঠাৎ বৃষ্টির পানিতে গজে উঠা ঘাস, ভুট্টার কচি পাতা, ধানের কুশি, গুমা, হেলেন্চা, বোরো জমির ঘাস ও ইউরিয়া দেওয়া জমির ঘাস খেয়ে এ বিষক্রিয়ার সৃষ্টি হয়ে থাকে।
গর্ভবতী গাভী ও বাচ্চা গরু তুলনা মুলক নাইট্রেট বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত বেশি হয়ে থাকে।
আক্রান্ত গরুর দ্রুত শ্বাসকষ্ট, পেশীর কম্পন, লালা ক্ষরন, পেটে শুল, ব্যাথা ও ডায়রিয়া দেখা দিতে পারে।
তীব্র বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত গরু শুয়ে পরে মাথা মাটিতে নুয়ে দেয় এবং রোগ সনাত্নক ও চিকিৎসা প্রদানের আগেই মারা যায়।
এ রোগ নির্নয় করা হয় অপরিপক্ব নতুন গজানো ঘাস খাওয়ার ইতিহাস ও বৈশিষ্ট্যপুর্ন উপসর্গ দেখে।
ইউরিয়া বিষক্রিয়া
সরাসরি ইউরিয়া খাওয়ানো বা ভুল পদ্ধতিতে ইউরিয়া প্রয়োগের কারনে এই বিষক্রিয়ার সৃষ্টি হয়ে থাকে।
মোটাতাজাকরন এর ক্ষেত্রে ইউরিয়া মিশ্রিত খড়, ইউ.এম.এস, ইউরিয়া মোলাসেস ব্লক প্রস্তুত করার সময় মাত্রাতিরিক্ত ইউরিয়া মেশানো এবং উক্ত খাদ্য পরিমানে বেশি খাওয়ানোর ফলেও হতে পারে।
এছাড়া ইউরিয়া প্রয়োগ করা জমির ঘাস খাওয়ানো এবং রাইচ মিলে চাউল সাদা করার জন্য ব্যবহৃত ইউরিয়া মিশ্রিত ধানের কুড়া খেয়ে এই বিষক্রিয়ার সৃষ্টি হয়ে ৩০-৪০ মিনিটের মধ্যে গরু মারা যেতে পারে।
ইউরিয়া বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত গরুর শ্বাসকষ্ট, শরীরের তাপমাত্রা কমে যাওয়া, পেট ফাপা ও ব্যাথা, দুর্বলতা, পেশীর কম্পন, ফেনাযুক্ত লালা ঝরা, মাথা মাটির সাথে রেখে শুয়ে পরা এবং আক্রান্তের আধা ঘন্টার মধ্যেই মারা যাওয়া।
ইউরিয়া মিশ্রিত খাবার খাওয়ানোর ইতিহাস ও উল্লেখযোগ্য উপসর্গ দেখে এ রোগ নির্নয় করা হয়।
কীটনাশক বিষক্রিয়া
গবাদিপশুর খাদ্যে যে কোন ভাবে কীটনাশক মিশে গেলে এবং কীটনাশক মিশ্রিত উক্ত খাদ্য গরু খেলে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে।
শস্যক্ষেতের কীট-পতঙ্গ পোকা মাকড় ধ্বংশ করার জন্য ব্যবহৃত কীটনাশক প্রয়োগ করা শস্য ও ঘাস খেয়ে এবং গবাদিপশুর বহিঃপরজীবি দমন করার জন্য বিভিন্ন প্রকার ঔষধ যেমন ম্যালাথিওন, প্যারাথিওন কার্বোনেট জাতীয় ঔষধ অসাবধানতায় ব্যবহারের ফলে হতে পারে।
এছাড়াও গবাদিপশুকে শত্রুতা বশতঃ কীটনাশক খাওয়ানোর মাধ্যমে এই কীটনাশক বিষক্রিয়া হয়ে থাকে।
কীটনাশক বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত গরুর তাপমাত্রা কমে ৯৮-১০০ ডিঃ ফাঃ পর্যন্ত হওয়া, মুখ দিয়ে ফেনা ঝরা, শ্বাস কষ্ট, অস্থিরতা, তীব্র ডায়রিয়া, চোখ সংকোচিত হওয়া, পেশীর কম্পন ও খিচুনী, পেট ব্যাথা ও ফেপে যাওয়া, দুর্বল হয়ে শুয়ে পরা, এবং সর্বশেষ পরিস্থিতি কয়েক ঘন্টার মধ্যে মারা যাওয়া ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিবে।
এই বিষক্রিয়া নির্নয় করা হয় কীটনাশক মিশ্রিত খাবার খাওয়ানোর ইতিহাস, বহিঃপরজীবি দমনে ঔষধ প্রয়োগ করা, পরীক্ষাগারে খাদ্য ও মৃত গরুর নমুনা পরীক্ষা করে এবং বৈশিষ্ট্যপুর্ন উপসর্গ দেখে।
গাছ-গাছড়া বিষক্রিয়া
বিষাক্ত গাছ-গাছড়া লতা পাতা খেয়েও গবাদিপশু খাদ্য বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে থাকে।
কিছু কিছু গাছ-গাছড়া তীব্র বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে গরুর মৃত্যু নিশ্চিত করে আবার কিছু গাছ-গাছড়া খেলে সামান্য উপসর্গ প্রকাশ পাবে তবে মৃত্যুর ঝুকি থাকে না।
বিষাক্ত গাছ-গাছড়া লতা পাতায় প্রচুর পরিমানে হাইড্রোসাইনিক এসিড (HCN) বিদ্যমান থাকায় পরবর্তিতে এর Toxic principle পশুর দেহে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
যার ফলে দেহের অভ্যন্তরীন অঙ্গের প্রদাহ জনিত এবং অবক্ষয় জনিত পরিবর্তন হয়ে থাকে।
আক্রান্ত গরুর মুখ হতে তিক্ত গন্ধ বের হওয়া, হাটতে গেলে টলে পরে যাওয়া, শ্বাস কষ্ট, ফেনা ঝরা, স্নায়ুতন্ত্রের বিষক্রিয়া, আলো সংবেদনশীলতা ও ফুসফুসের শোথের সৃষ্টি হওয়া ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিয়ে থাকে।
উল্লেখিত উপসর্গ দেখে এবং মৃত গরুর পাকস্থলীর ও অন্ত্রের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষাগারে রাষায়নিক পরীক্ষা করে এ রোগ নির্নয় করা হয়।
আর্সেনিক বিষক্রিয়া
আর্সেনিক বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত গরু অল্প কিছুক্ষনের মধ্যে মারা যায়। চিকিৎসা দিয়েও তেমন কোন উপকার পাওয়া যায়।
বিভিন্ন ধাতব পদার্থ যেমন রং এর খালি পাত্র যেখানে সেখানে ফেলে রাখলে এবং উক্ত পাত্র গরু চাটার মাধ্যমে, ত্বক রং করা মিশ্রন ইত্যাদি দ্বারা এই বিষক্রিয়ার সৃষ্টি হয়ে থাকে।
আর্সেনিক বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত গরুর লক্ষন তীব্র ও নাতি প্রবল অবস্থায় পিছনের পায়ে প্যারালাইসিস হওয়া সহ পানি পিপাসা, লালা ঝড়া, ডায়রিয়া এবং তাপমাত্রা কমে যেতে পারে।
স্নায়বিক ও দীর্ঘস্থায়ী অবস্থায় মাংশপেশীর খিচুনি, শরীরে ব্যালান্চ না পাওয়া এবং শরীরের পশম ঝড়ে পরা, নাক মুখ ফুলে যেতে পারে।
রোগের ইতিহাস ও উল্লেখযোগ্য উপসর্গ দেখে আর্সেনিক বিষক্রিয়া নির্নয় করা যায়।
সম্ভাব্য ব্যবস্থা
খাদ্য বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত গরুকে যত তারাতাড়ি সম্ভব কারন সনাক্ত করে (ডিভিএম, ডিএলও, টিএলও, ভিএস) দ্বারা চিকিৎসা প্রদান করতে হবে। নাইট্রেট, কীটনাশক, আর্সেনিক, ইউরিয়া ও বিষাক্ত গাছ-গাছড়া বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত গরুর চিকিৎসা একটু ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে।
প্রাথমিক অবস্থায় গরুকে ঠান্ডা ও ছায়াযুক্ত স্থানে রাখা ও পানি পান করানো যেতে পারে।
নাইট্রেট বিষক্রিয়া
® মিথাইলিন ব্লু ১% সলুউশন দৈহিক এক কেজি/১-২ মিলিগ্রাম হিসাবে আস্তে আস্তে শিরায় দিতে হবে।
প্রয়োজনে পুনরায় ২ ঘন্টা পর আবার দিতে হবে।
® এন্টিহিস্টামিন সহ 5% Dextrose saline 1-3 bags শিরায় দিতে হবে।
® inj: Nervin 2ml বড় গরুর জন্য ২০ মিলি মাংশে একবার দিতে হবে।
কীটনাশক বিষক্রিয়া
® এন্টিহিস্টামিন সহ 5% or 10% Dextrose saline বড় গরুর জন্য 2-3 bags শিরায় দিতে হবে।
® ১০-১২ টি হাস অথবা মুরগীর ডিমের সাদা অংশ খাওয়াতে হবে।
® inj: Atropin Sulphete 1ml (Jayson) মানুষের ঔষধ। মাঝারী ও বড় গরুর জন্য ১০ সিসি শিরায়, ১০ সিসি মাংশে, ১০ সিসি চামড়ার নিচে প্রয়োগ করতে হবে। ৪-৫ ঘন্টার মধ্যে সুস্থ না হলে পুনরায় একই মাত্রায় আবার প্রয়োগ করতে হবে।
ইউরিয়া বিষক্রিয়া
® এন্টিহিস্টামিন সহ 5% or 10% Dextrose saline বড় গরুর জন্য 1-2 bags শিরায় দিতে হবে।
® মাঝারি ও বড় গরুর জন্য, ভিনেগার ২-৪ লিটার খাওয়াতে হবে।
® ভিটামিন বি কমপ্লেক্স জাতীয় ইন্জেকশন যেমন V-Plex 10ml or B-50 vet 10 মাংশে দিতে হবে।
গাছ-গাছড়া বিষক্রিয়া
® এন্টিহিস্টামিন সহ 5% Dextrose saline বড় গরুর জন্য 1-2 bags শিরায় দিতে হবে।
® মাঝারি ও বড় গরুর জন্য ৩০ গ্রাম সোডিয়াম থায়োসালফেট এবং ৫০০ মিলি পানি একত্রে মিশিয়ে স্টমাক টিউবের সাহায্যে খাওয়াতে হবে।
অথবা
সোডিয়াম নাইট্রাইড ৩ গ্রাম এবং সোডিয়াম থায়োসালফেট ১৫ গ্রাম এক সাথে পরিশ্রুত পানিতে মিশিয়ে শিরায় দিতে হবে।
আর্সেনিক বিষক্রিয়া
® বড় ও মাঝারি গরুকে ৫০০-৭০০ মিলি কাঁচা তিসির তেল স্টমাক টিউবের সাহায্যে খাওয়াতে হবে।
® ১০-১২ টি হাস অথবা মুরগীর ডিমের সাদা অংশ খাওয়াতে হবে।
® মাঝারি ও বড় গরুর জন্য ৩০-৬০ গ্রাম সোডিয়াম থায়োসালফেট ৪০০ মিলি পানিতে মিশিয়ে স্টমাক টিউবের সাহায্যে খাওয়াতে হবে। সুস্থ না হলে ৪-৫ ঘন্টা পর পুনরায় আবার খাওয়াতে হবে।
® ৩০ গ্রাম সোডিয়াম থায়োসালফেট ২০০ মিলি পরিশ্রুত পানিতে মিশিয়ে শিরায় দিতে হবে।
প্রতিরোধ
> কীটনাশক প্রয়োগ করা জমির ঘাস, শস্য না খাওয়ানো।
> বিষাক্ত ও অজানা গাছ-গাছড়া, লতা পাতা খাওয়ানো থেকে গবাদিপশুকে বিরত রাখা।
> হাইড্রোসাইনিক যুক্ত ঘাস, লতা পাতা, ধানের কুশি, হঠাৎ বৃষ্টির পানিতে গজে উঠা যে কোনো ঘাস না খাওয়ানো।
> রাইচ মিলের ধানের গুড়া খাওয়ানোর আগে ইউরিয়ার ব্যবহার হয়েছে কিনা তা জেনে নিশ্চিত হওয়া।
> হঠাৎ করে ইউরিয়া মোলাসেস ব্লক মাত্রাতিরিক্ত খাওয়ানো যাবে না এবং ১২ ঘন্টা বা তার অধিক অভুক্ত গরুকে ইউরিয়া খাওয়ানো যাবে না।
> বহিঃপরজীবি দমনে ব্যবহৃত ঔষধ বিশেষ সতর্কতার সহিত ও চিকিৎসকের পরার্মশ অনুযায়ী প্রয়োগ করা।
> তীব্র বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত গরুকে ঠান্ডা স্থানে রাখা, পানি পানের ব্যবস্থা করা, আক্রান্তের কারন গুলো সনাক্ত করে দ্রুত চিকিৎসকের শরনাপন্ন হওয়া ও অধিক সেবা শশ্রুতা দান করা।
খাদ্যে বিষক্রিয়া ( Food Poisoning) কার্বোহাইড্রেট ইনগোর্জমেন্ট :
লক্ষণ: বিষাক্ত কোন কিছু খেয়ে ফেললে খাদ্যে বিষক্রিয়া হয়।
আর ভাত অতিমাত্রায় খেয়ে ফেললে কার্বোহাইড্রেট ইনগোর্জমেন্ট হয়।
চিকিৎসা:
(১০০ থেকে ১৫০ কেজি দৈহিক ওজনের জন্য)
১. এস.আর.বভি (S. R. Bovi)
ব্যবহার:
প্রতিবারে ১প্যাকেট হালকা গরম পানিতে মিশিয়ে দিনে ২ বার করে খাওয়াতে হবে।
২. প্রোবায়োটিক প্লাস ( Probiotic Plus)
ব্যবহার:
প্রতিবারে ১০০-২০০ গ্রাম দিনে ২ বার খাওয়াতে হবে।
৩. ডেস্কট্রোজ পাউডার (Dextrose Powder)
ব্যবহার:
প্রতিবারে ১০০-১৫০ গ্রাম দিনে ২ বার খাওয়াতে হবে।
কালেক্টেড