আমি ফ্যাসিওলা বলছি…
???????
আমাকে চিনতে পারছেন?
আমি লিভার ফ্লুক/কলিজা কৃমি। অন্ত্রে বসবাসকারী যত কৃমি আছে তার মধ্যে পাতার মত চ্যাপ্টা আকৃতির পূর্ণাঙ্গ কৃমিটাকে বলা হয় ট্রেমাটোড বা ফ্লুক। আমার বসবাস অবশ্য পিত্তনালীতে। আর পিত্তনালীতে ঢোকার আগে আমি লিভারকে বিনষ্ট করি তাই আমার নাম লিভার ফ্লুক। অবশ্য ডাক্তাররা আমাকে ফ্যাসিওলা বলে ডাকে।
আমরা ২ ভাই।
১। আমার ছোট ভাই ফ্যাসিওলা হ্যাপাটিকা অবশ্য ইউরোপ ও আমেরিকায় ঘুরে বেড়ায়।
২। আর আমি ফ্যাসিওলা জাইগানটিকা আফ্রিকা ও এশিয়ার মত ট্রপিক্যাল দেশগুলোতে ঘুরি।
আমাদের গায়ের রং ধূসর তামাটে। আর লম্বায় আমরা ৩ থেকে ৭ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকি।
আমার দেহে ২টি সাকার আছে। একটি ওরাল সাকার মানে মুখের দিকে সেখানে অবশ্য স্পাইন মানে কাঁটা থাকে আরেকটি ভেন্ট্রাল সাকার মানে লেজের দিকে। দুঃখের বিষয় আমার কোন দেহ গহ্বর নেই। কিন্তু মুখগহ্বর, ফ্যারিংক্স, ইসোফেগাস এবং একজোড়া ছিদ্রবিহীন আন্ত্রিক সিকা আছে। আমি রক্ত এবং মৃত কোষকলা খেয়ে থাকি এবং আমার সিকামে সেগুলো হজম এবং শোষিত হয়।
ও হ্যা, আমি কিন্তু উভলিঙ্গ। মানে আমার একই শরীরে স্ত্রীজননতন্ত্র এবং পুরুষ জননতন্ত্র আছে। পুরুষ অঙ্গে ভাসডিফারেন্স যুক্ত একজোড়া টেস্টিস থাকে এবং সেমিনাল ভেসিকল ও সিরাসযুক্ত সিরাস স্যাক থাকে যেটা জেনিটাল ছিদ্র পর্যন্ত পৌঁছে। আর স্ত্রী অঙ্গে ক্রমান্বয়ে একটি ডিম্বাশয়, ডিম্বনালী ও ইউটেরাস ঐ জেনিটাল ছিদ্রের সাথে এসে সংযুক্ত হয়। ইউটেরাসের ভিতর যে ভাইটালিন গ্রন্থি থাকে সেখান থেকে এক ধরণের নিঃসরণ দিয়ে প্রথমে ডিম্বকুসুম এবং শেষে খোলস সৃষ্টি হয়ে পূর্ণাঙ্গ ডিমে পরিণত হয় যা জেনিটাল ছিদ্র দিয়ে বেরিয়ে আসে। তারপর সিরাসের সাথে এসে মিলিত হয় এবং ফার্টিলাইজেশন ঘটে। কি আশ্চর্য তাই না!
আমার ডিম দেখতে ঠিক নীচের ছবিগুলো দেখুন।
? চলুন আমার জীবনচক্র সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাকঃ
পোষকের পিত্তনালীতে অবস্থান করে আমি ডিম দিতে থাকি। এসব ডিম পিত্তের সাথে অন্ত্রনালীতে প্রবেশ করে এবং সেখান থেকে মলের সাথে বেরিয়ে মাটিতে আসি।
?
অনুকূল পরিবেশে ৯ দিনের মধ্যে ডিম থেকে চলাচলে সক্ষম মিরাসিডিয়াম হয়ে বেরিয়ে আসি এবং 24-30 ঘণ্টার মধ্যে উপযুক্ত মাধ্যমিক পোষকের শামুকের মধ্যে প্রবেশ করি। এই সময়ের মধ্যে উপযুক্ত শামুক না পেলে মিরাসিডিয়াম গুলি মারা যায়। উল্লেখ্য আমাদের জীবন বাঁচানোর জন্য কেবল লিমনিয়া রুফেসেন্স এবং লিমনিয়া একুমিনাটা নামক শামুক দরকার।
?
মিরাসিডিয়াম শামুকের ভিতরে প্রথমে স্পোরোসিস্ট এরপরে রেডিয়া এবং শেষে সারকারিয়া সৃষ্টি করে।
?
সারকারিয়া শামুক থেকে বেরিয়ে ঘাস এবং জলজ উদ্ভিদে লেগে থাকে। প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার জন্য এই সময় সারকারিয়া মেটাসারকারিয়ায় রূপান্তরিত হয়। একটা মিরাসিডিয়াম থেকে 600 এর বেশি মেটাসারকারিয়া তৈরি হয়। আর এই পর্যায় সম্পন্ন হতে কমপক্ষে ছয় থেকে সাত সপ্তাহ লেগে যায়।
?
মেটাসার্কারিয়া যুক্ত ঘাস পশুর অন্ত্রে প্রবেশ করে। সেখানে সার্কারিয়া সিস্ট থেকে বেরিয়ে আসে। তারপর অন্ত্রের প্রাচীর ছিদ্র করে পেরিটোনিয়াম পার হয়ে যকৃত/লিভারে পৌঁছে।
?
যকৃতের প্যারেনকাইমায় ৬-৮ সপ্তাহ থেকে তরুণ ফ্লুক ক্ষুদ্র পিত্তনালীতে প্রবেশ করি এবং শেষে প্রধান পিত্তনালীতে পৌঁছে প্রাপ্তবয়স্ক কৃমিতে পরিণত হই। এই পিত্তনালীতে আমি ২৬ মাস বেঁচে থাকতে পারি।
এই হলো আমার জীবনচক্র। আমার জীবনচক্র সম্পন্ন হতে মোট ১৭ সপ্তাহ সময় লাগে। আমি অবশ্য এর মধ্যে ৩ মাস ঘুমিয়েই থাকি। সবচেয়ে বেশি ডিম পাড়ি ৩ থেকে ৮ মাসে। ডিম পাড়া বন্ধ করি ১০ মাস বয়সে। ??
?এরপর কথা বলব, কিভাবে রোগ তৈরি করি এবং কি কি লক্ষণ প্রকাশ পায় আক্রান্ত পশুর?
কতসংখ্যক মেটাসারকারিয়া দেহে প্রবেশ করে তার উপরে রোগের লক্ষণ নির্ভর করবে। যেমন ধরুনঃ ১। অল্প সময়ের মধ্যে প্রচুর সংখ্যায় মেটাসারকারিয়া দেহে প্রবেশ করল। এক্ষেত্রে একিউট বা তীব্র রোগ তৈরি হবে। মানে তীব্র যকৃত প্রদাহ এবং রক্তক্ষরণের কারণে উপসর্গ প্রকাশের পূর্বেই পশুর হঠাৎ মৃত্যু ঘটবে। এক্ষেত্রে কৃমির মাইগ্রেশনে যকৃত টিস্যু ধ্বংস হয় এবং প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। এবং প্রাপ্তবয়স্ক কৃমি রক্তশোষণের ফলে পশুর দেহে লৌহ তথা আয়রণের ঘাটতি দেখা দেয়। এছাড়া আমার শরীর থেকে বিষাক্ত প্রোলিন নিঃসরণ করি যা অস্থিমজ্জার কার্যক্ষমতা হ্রাস করে ফলে লোহিত রক্ত কণিকা তৈরি হতে পারে না। এমনকি পিত্তনালীতেও আমি রক্তচুষে খাই এবং পিত্তনালী প্রদাহ/ কোলাঞ্জাইটিস ঘটিয়ে ফাইব্রোসিস সৃষ্টি করি ফলে পিত্তরস বের হতে পারে না। তাই প্রয়োজনীয় পরিমান পিত্ত অন্ত্রনালীতে না যেতে পারার কারণে পশুর বদহজম, ক্ষুধামন্দা, মাঝে মাঝে ডায়রিয়া, বিমর্ষতা, দূর্বলতা পরিলক্ষিত হয়। এছাড়া পেটে ব্যথা থাকে এবং চোখের কঞ্জাংটিভা ফ্যাকাসে হয়।
এভাবে আমরা সারাদিনে ০.৫ মিলি থেকে ১০ মিলি পর্যন্ত রক্ত খেতে পারি। ফলে পশুর দেহে রক্তাল্পতা দেখা দেয়। লিভারে প্রোটিন সংশ্লেষণ হ্রাস পায়। এতে হাইপোপ্রোটিনেমিয়া তথা বটল জ্ব (সাবম্যান্ডিবিউলার ইডিমা) দেখা দেয়।
২। দীর্ঘ সময় ধরে প্রচুর সংখ্যায় মেটাসারকারিয়া দেহে প্রবেশ করলে মাঝারী-তীব্র বা Sub-Acute রোগ তৈরি হবে। এবং
৩। দীর্ঘবসময়ে অল্পসংখ্যক মেটাসারকারিয়ার সংক্রমণে ক্রোনিক/দীর্ঘমেয়াদি রোগ তৈরি হবে। যেমন ধরুন, আমি লিভারে যে ক্ষত তৈরি করি, সেখানে ক্লস্ট্রিডিয়াম নোভাই নামের ব্যাক্টেরিয়া খুব সুন্দরভাবে বংশবৃদ্ধি করতে পারে। এতে পশুর মৃত্যু ঘটতে পারে।
? এবার আমাকে কিভাবে মারতে পারবেন মানে পশুকে কিভাবে চিকিৎসা করবেন সে ব্যাপারে বলিঃ
নীচে যে কৃমিনাশক ঔষধগুলোর নাম বলছি এগুলো পশুর প্রতিকেজি দৈহিক ওজনের জন্য ১০ থেকে ১৫ মিলিগ্রাম করে ব্যবহার করলে আমাকে ধ্বংস করতে পারবেন।
তবে এক্ষেত্রে অধিক সুফল পাওয়ার জন্য যেকোন একটি ঔষধ প্রথম মাত্রার তিন সপ্তাহ পরে দ্বিতীয় মাত্রা প্রয়োগ করতে পারবেন।
১। ট্রাইক্লাবেন্ডাজল (৯৯% কার্যকরী, সব বয়সের কৃমিকে মারতে পারে)
২। নাইট্রোক্সিনিল (৮৫%, শুধু অধিক বয়স্ক কৃমিকে মারতে পারে)
৩। অক্সিক্লোজানাইড (৯০%)
৪। এলবেন্ডাজল (৬৫%)
৫। হেক্সাক্লোরোফেন (৮৫%)
সহায়ক চিকিৎসাঃ
১। দূর্বলতা ও ডিহাইড্রেশনের জন্য ডেক্সট্রোজ স্যালাইন শিরার মাধ্যমে প্রয়োগ করা যায়।
২। রক্তাল্পতার জন্য ভিটামিন ও মিনারেল অ্যামাইনো এসিড সমৃদ্ধ ঔষধ ইঞ্জেকশন মাংসে দিতে হবে।
৩। কৃমির চিকিৎসায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে ক্যালসিয়াম জাতীয় প্রিমিক্স খাওয়াতে হবে।
৪। ক্ষতিগ্রস্থ লিভারকে দ্রুত সারাতে ভালো মানের কেমিক্যাল লিভার টনিক ব্যবহার করতে হবে।
ডাঃ পবিত্র মোহন্ত
01719329794
Please follow and like us: