গরুর জাত পরিচিতি (ফ্লেকভি)
গরুর নাম : ফ্লেকভি।
যেকোন আবহাওয়ায় পালন করার উপযোগীতার জন্য ‘ইউনিভার্সাল’ গরু হিসাবে পৃথিবীতে পরিচিত এবং বর্তমান সময়ের সবচে লাভজনক এবং সবচে জনপ্রিয় ডুয়াল পারপাস (মাংস এবং দুধ) গরু ‘ফ্লেকভি’ আমাদের আজকের আলোচিত গরু।
গরুর বিস্ময় জাত ফ্লেকভিকে বেস্ট ট্রিপল পারপাস গরু ও বলা হয়, কারণ এটা মাংসর জন্য, দুধের জন্য এবং যেকোনো আবহাওয়া তে উপযোগী।
গড় ওজন : ষাঁড় : ১০০০-১৩০০ কেজি ।
গাভী : ৭০০-৮০০ কেজি।
উৎস দেশ :
১৪০০ বছর আগে থেকে সুইজারল্যান্ডে পালন করা হতো ‘সুইস ফ্লেকভি’ নামের বড় আকৃতির সিমেন্টাল গরু। ব্যবহার করো হতো মূলত কৃষিকাজ, গরুর গাড়ি টানা এবং দুধ ও মাংসের জন্য।
কিন্তু অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে এবং ঊনবিংশ শতকের প্রথম দিকে জার্মানি এবং অস্ট্রিয়া ও পার্শবর্তী এলাকার গরুর উন্নয়নের জন্য ‘সুইস ফ্লেকভি’ গরুর সাথে স্থানীয় একাধিক জাতের সাথে ক্রস করা হলেও, সবচে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে স্থানীয় শক্ত এবং লাল সাদা রঙের রোগ প্রতিরোধী গরুর সাথে প্রাকৃতিক ভাবে উন্নয়ন করা গরুর নতুন জাত, কিন্তু পুরান ‘ফ্লেকভি’ নামটাই থেকে যায় পরিচিতি হিসাবে।
তাই পুরান ‘সুইস ফ্লেকভি’ জাতের উৎসস্থান সুইজারল্যান্ড হলেও নতুন এই জাতের উৎস স্থান জার্মানি ও অস্ট্রিয়া (প্রাচীন বাভারিয়া)।
ইতিহাস :
ফ্লেকভি জাতের গরুর ইতিহাস নিয়ে মতভেদ থাকলেও সবচে প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস হচ্ছে কৃষিকাজ, গরুর গাড়ি টানা এবং দুধ ও মাংসের জন্য ১৪০০ বছর আগে থেকেই সুইজারল্যান্ডে ‘সুইস ফ্লেকভি’ নামের বড় আকৃতির সিমেন্টাল গরু পালন করা হতো।
জার্মানিতে স্থানীয় জাতের গরুর দুধ ও আকৃতি উন্নয়নের জন্য ১৮৩০ সালে ‘ম্যাক্স ওবেরমেয়ের’ নামের জনৈক ব্যক্তি এই এই জাতের গরু জার্মানিতে আমদানি করেন এবং স্থানীয় সবচে শক্ত এবং রোগ প্রতিরোধী লাল সাদা জাতের সাথে ক্রস করেন এবং সৃষ্টি হয় নতুন শক্ত, রোগ প্রতিরোধী ডুয়াল পারপাস এক নতুন জাত কিন্তু নামটা আগের মতোই ‘ফ্লেকভি’ থেকে যায়।
১৮৩০ : অস্ট্রিয়া সুইস সিমেন্টাল এলাকা থেকে হলুদ রং এর গরু আমদানি করে এবং লোকাল লাল সাদা কালার এর রোগ প্রতিরোধী এবং শক্ত জাতের ফ্লেকভি জাতের সাথে ক্রস করা হয়।
১৮৯৪ : অস্ট্রিয়ান সিমেন্টাল ফ্লেকভি ব্রিডিং এসোসিয়েশন গঠন।
১৮৯৫ : আমেরিকায় ফ্লেকভি গরুর আমদানি।
১৮৯৫ : সাউথ আফ্রিকায় ফ্লেকভি গরুর আমদানি।
১৯১৮ : ব্রাজিলে ফ্লেকভি গরুর আমদানি।
১৯২২ : আর্জেন্টিনায় ফ্লেকভি গরুর আমদানি।
১৯৭২ : অস্ট্রেলিয়ায় ফ্লেকভি গরুর আমদানি।
১৯৭৪ : নিউজিল্যান্ডে এই জাতের গরুর আমদানি।
১৯৯৭ : টোটাল মেরিট ইনডেক্স এ দুধ, মাংস এবং রোগ প্রতিরোধী এবং যেকোনো আবহাওয়া উপযোগী গরু হিসাবে রেকর্ড করা হয়।
পালনকারী দেশ ও সংখ্যা :
পৃথিবীর মোট জেবু জাতের সংখ্যার পরেই একক জাত হিসাবে ফ্লেকভি হচ্ছে সবচে সংখ্যাধিক্য গরুর জাত।
গরু নিয়ে কাজ করে এরকম একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কয়েক বছরের পুরান গবেষণায় দেখা গেছে পৃথিবীর মোট এই জাতের নিবন্ধিত গরুর সংখ্যা ৪১ মিলিয়ন এবং অস্ট্রিয়াতে রেজিস্টার্ড ফ্লেকভি গরুর সংখ্যা ১৬০,০০০০।
পালনকারী দেশের মধ্যে রয়েছে : ল্যাটিন আমেরিকার প্রায় সব দেশ, আফ্রিকার কেনিয়া সহ আফ্রিকার প্রধান প্রধান গরু পালনকারী দেশ, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং ইউরোপের প্রায় সব দেশ। এছাড়া ফ্লেকভি প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা এবং দেশে জ্যামিতিক হরে ছড়িয়ে পড়ছে।
বৈশিষ্ট ও সুবিধা :
সাদা মুখ, সাদা কপাল এবং লাল বা লালচে লালা সাদা মিশ্রিত শরীরের গরু ফ্লেকভি দেখতে খুবই মায়াবী। সাদা ক্ষুর এবং ক্ষুরের উপরের অংশ সাদা ও লেজের শেষ অংশ সাদা হওয়ায় ফ্লেকভি গরুকে সহজেই অন্য গরু হতে আলাদা করা যায়।
চরম ভাবাপন্ন শীত ও গরম আবহাওয়ায় এবং রোগ প্রতিরোধী হিসাবে সবচেয়ে জনপ্রিয় গরু হিসাবে ফ্লেকভির রয়েছে বেশ কিছু বাড়তি গুনাগুন, যা অন্য বস টোরাস (ইউরোপিয়ান) জাতের গরুতে খুব কম দেখা যায়।
বিশাল আকৃতির লাল এবং সাদা রং এর মিশ্রণ এই গরুকে আলাদা সৌন্দর্য দান করেছে।
এই জাতের গরুর শরীরে উপরের ভাগ লাল হলেও পেটের নিচের ভাগ এবং মুখের কাছে ও পা এর নিচের অংশে সাদা রং এর আধিক্য দেখা যায়। এই গরু যেমন ইউরোপের শীতপ্রধান আবহাওয়া তে সহজে মানিয়ে নিতে পারে তেমনি কেনিয়ার প্রচন্ড গরমেও এটার কোনো সমস্যা হয়েছে বলে কোনো রেকর্ড নাই।
এটাই একমাত্র গরু যা মাংসৰ জন্য যেমন জনপ্রিয় তেমনি দুধের জন্য।
বস টোরাস জাতের মধ্যে ‘জার্সি’ জাতের মতো আরেকটি উচ্চ প্রজনক্ষম এই জাতের গরুর বাচ্চা প্রসবজনিত সমস্যার রেকর্ড ও খুব কম।
বস টোরাস জাতের মধ্যে সবচে দীর্ঘ জীবনের অধিকারী এই গরুর বাচ্চার সংখ্যাও অন্য বস টোরাস (ইউরোপিয়ান) গরুর গরুর চেয়ে বেশি হয়।
বিশালাকৃতির গরু হলেও শান্ত শিষ্ট গরু হওয়ায় এটা পালন যেমন সহজ তেমনি পরিবহন ও সহজ।তাছাড়া এই গরুর জন্য কোনো বিশেষ খাবার ও দরকার হয়না এবং অল্প খাবারেও দীর্ঘ সময় শরীর বৃত্তীয় ক্ষমতা অটুট থাকে।
দুধ ও মাংস উৎপাদন :
এই জাতের গরু এক উৎপাদনকালে গড়ে ৯০০০০-১০০০০ কেজি (প্রথম বাচ্চার পর ৭০০০ কেজি) দুধ দেয় এবং উৎপাদনকাল ৩১০-৩৬০ দিন (উৎপাদনে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন ছাড়া)।
এই জাতের গরুর দুধে ফ্যাট এর গড় পরিমান ৪.২% থেকে ৪.৪ % এবং মিল্ক প্রোটিন ৩.৫ থেকে ৩.৮ % । এই গরুর দুধের বিশেষ বৈশিষ্ঠ্য হচ্ছে এর দুধে অধিক পরিমানে উপকারী ওমেগা ৩ ফ্যাট বিদ্যমান।
এছাড়া এটার দুধের রয়েছে আরো কিছু গুনাগুন যা এটাকে এখন দুধের গরু হিসাবে বেশিরভাগ জায়গা হোলস্টাইন ফ্রিজিয়ান জাতের গরুর বিকল্প হিসাবে পালন করা হচ্ছে।
ফ্লেকভি গাভী থেকে জন্ম নেয়া ষাঁড় প্রথম ২০০ দিনে ১.৪ কেজি করে বৃদ্ধি পায় যা যেকোনো ইন্ডিজেনাস গরুর জন্য সর্বোচ্চ এবং এটার মাংস অন্যান্য ইউরোপিয়ান মাংস হতে বেশি সুস্বাদু বলে প্রমাণিত হয়েছে।
তাছাড়া এই জাতের গরু দেখতে অন্যান্য গরু থেকে দেখতে সুন্দর হওয়ায় এটার ষাড়ের বাজার মূল্য অন্যান্য ইউরোপিয়ান ব্রীড এর চেয়ে অনেক বেশি।
অর্থনৈতিক গুরুত্ব :
রোগ প্রতিরোধী হওয়াতে ফ্লেকভি চিকিৎসা খরচ প্রায় ৩০-৪০% কম দরকার হয়। এছাড়া হোলস্টাইন ফ্রিসিয়ান এর তুলনায় এটা ২৫ % খাবার কম খায়, যে কারণে ৩ বছর এর মধ্যে কেনিয়ার ২০০০০ খামারী ফ্রিজিয়ন পরিবর্তন করে ফ্লেকভি পালন শুরু করছে।
অস্ট্রিয়াতে করা এক গবেষণায় দেখা গেছে ফ্লেকভি জাতের গরুর গড় এল ডি এ (লেফট ডিস্প্লেসড অবমাসামস) সমস্যা ০.৫% যা হোলস্টাইন ফ্রিজিয়ান এর ক্ষেত্রে ৫ %। এছাড়া এই জাতের গরুর রয়েছে যেকোনো আবহাওয়া তে সহজে মানিয়ে নেয়ার সহজাত ক্ষমতা।
চামড়া মোটা হওয়াতে যেকোনো টিক্স (চামড়ার উপরের পরজীবি পোকা) এটাকে সহজে আক্রান্ত করতে পারেনা। ফ্লেকভি পরীক্ষিত গাভী যেটার সপ্তম বা অষ্টম বচ্চা দেয়ার পরেও দুধ দেয়ার ক্ষমতা বা প্রজনন ক্ষমতা অপরিবর্তিত থাকে এবং এর ষাড় দেড় বছরের মধ্যে ৫০০ কেজি হয় ।
ফ্রিজিয়ান যেখানে গড়ে ৭ টা বাচ্চা দেয়ার মধ্যেই পালনের অনুপযোগী হয়ে যায় সেখানে ফ্লেকভি গড়ে ১০ টা পর্যন্ত বাচ্চা দেয় দুধ উৎপাদনের কোনো পরিবর্তন ছাড়া।
এই জাতের অর্থনৈতিক গুরুত্ব এমন পর্যায়ে পৌছেছে যে, ইউরোপের বাজারে বর্তমানে একটা এক মাস বয়সী ফ্লেকভির বাছুর এর দাম ২৫০ ইউরো যেখানে ফ্রিজিয়ান এর দাম ১২০ ইউরো এবং স্বল্প সময়ে এখন পৃথিবীর দ্বিতীয় প্রধান পালিত গরু।।
আর এটার প্রজনন ক্ষমতা এমন যে এই জাতের একটা গভীর প্রজননে যেখানে ১.৮ টি সংখ্যায় সিমেন স্ট্র দরকার হয় সেখানে ফ্রিজিয়ান এর প্রজননে দরকার হয় গড়ে ৪ টি সিমেন স্ট্র, যা দ্বিগুনের চেয়ে বেশি।
একটা ফ্রিজিয়ান গরু তার লাইফটাইমে যে দুধ দেয় একটা ফ্লেকভি তার চেয়ে ৩০% বেশি দুধ দেয়, কারণ এটার জীবনকাল যেমন বেশি তেমনি দুধ উৎপাদন কাল ও বেশি।
ফ্লেক্সভি গরুর পালন খরচ ফ্রিজিয়ান এর চেয়ে কম হওয়ায় এটাকে এখন পৃথিবীর সবচে লাভজনক গরু হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ফ্লেকভি গরুর দুধ ও মাংস সুস্বাদু, উৎপাদন খরচ কম ও রোগ প্রতিরোধী হওয়ায় এবং দুধ উৎপাদন বেশি হবার কারণে এই গরুকে নিয়ে এখন ইউরোপ নিচের প্রবাদ গুলো প্রচলিত হয়ে গেছে :
“They simply get better the older they get!”
“They only have to look at the bull and they’re in-calf!”
“It’s not all about milk in the tank!”
“The beef is like a mini milk cheque!”
জীবনকাল :
ফ্লেকভি গরুর জীবনকাল এবং দুধ উৎপাদন বয়স হোলস্টাইন ফ্রিজিয়ান এর চেয়ে ২০% থেকে ৪০% বেশি, যে কারণে এই জাতের যেকোনো
গাভী যেকোনো ফ্রিজিয়ান গাভীর চেয়ে প্রায় ১৫-৩০% বেশি দুধ দেয়। রোগ প্রতিরোধী গরু হওয়ায় এটার চিকিৎসা খরচ অনেক কম। এটার গর্ভধারণ এবং বাচ্চা উৎপাদন জটিলতা অনেক কম হয়।
তাছাড়া ফ্রিজিয়ান এর চেয়ে ২৫ % খাবার কম খেয়ে এটা প্রায় সম পরিমান দুধ দেয়।
ফ্লেকভি গরু পালনে সমস্যা :
এই জাতের গরু ফ্রিজিয়ান এর চেয়ে দৈনিক ১-৩% দুধ কম দেয়।
পরিশেষে :
আমরা যারা খামার এর সাথে কম বেশি জড়িত আমাদের উচিত হবে সরকার কাছে দাবি করা, যত দ্রুত সম্ভব এই জাতের ষাঁড় এবং সিমেন আমাদের দেশে সরকারি ভাবে আমদানি করা, মাঠ পর্যায়ে পরীক্ষা করা এবং খামারিদের মধ্যে বিতরণ করা। যদিও বেসরকারী একটি কোম্পানী ইতিমধ্যে এই জাতের সেমেন পরীক্ষামুলক বাজারজাত শুরু করেছে।
Reference :
http://theorganicfarmer.org/Articl…/cow-high-milk-production
http://www.thecattlesite.com/breeds/dairy/115/fleckvieh/
http://www.moffettlivestock.co.uk/about-fleckvie…/ind