Breaking News

ছাগল পালন VS হুজুগ

ছাগল পালন VS হুজুগ
বাঙালির অনেকগুলো সহজাত প্রবৃত্তির মধ্যে হুজুগ একটি। হুজুগে বাঙালি প্রবাদটি তো আর এমনি এমনি তৈরি হয়নি।
কোনো একটি ঘটনা ঘটেছে কিনা, বা ঘটনাটির সত্যতা কতটুকু তা নিশ্চিত না হয়ে একটু আভাস পেলেই তুলকালাম ঘটিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে বাঙালির জুরি নেই।

মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে আসুন সবাই হুজুগ শব্দের উৎপত্তি সম্পর্কে জেনে নেই।
আরবি হুজম বা হজ্জৎ থেকে আসা হুজুক বা হুজ্জুক বা হুজুগ শব্দের আক্ষরিক অর্থ গোলমাল বা বাকবিতণ্ডা। অন্য অর্থ জনরব বা রটনা।
১২৯২ বঙ্গাব্দের পৌষ সংখ্যার “বালক” পত্রিকায় কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি বিজ্ঞাপন দেন। বিষয় বস্তু ছিল- যিনি হুজুগ শব্দের ভালো অর্থ বা সংজ্ঞা দিতে পারবেন, তাকে পুরস্কৃত করা হবে।
পরবর্তীতে হুজুগ নিয়ে যে সংজ্ঞাটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত করেছেন, তা হলো-
‘মাথা নাই মাথাব্যথা গোছের কতগুলো নাচুনে জিনিস লইয়া যে নাচন আরম্ভ হয়, সেই নাচনের অবস্থাকে হুজুগ বলে;
“বিশেষ কিছু হয় নাই অথবা অতি সামান্য একটা কিছু হইয়াছে আর সেইটা লইয়া সকলে নাচিয়া উঠিয়াছে, এই অবস্থার নাম হুজুগ।’

এবার আসি মূল আলোচনায়। ছেলেবেলা হতে সৌখিন মানসিকতা থাকার সুবাধে লেখক নিজেই বহুবার বহু হুজুগের বশবর্তী হইয়া বহু অর্থ বিয়োগ ঘটাইয়াছেন। তাই অভিজ্ঞতার ঝুলিটা নেহাতই কম নয়। তারই আলোকে আজকের লেখা।

★বেশ কয়েক বছর আগে সৌখিন কবুতর নিয়ে বাঙালির একটা হুজুগ পরিলক্ষিত হয়েছিল। সেই হুজুগে লেখকের মত অসংখ্য হুজুগে বাঙালীরই অর্থ ও স্বপ্নের অপমৃত্যু হয়েছিল।।
সেই রেশ কাটতে না কাটতেই চলে এলো টার্কি। সূচনা হলো এক নতুন অধ্যায়ের। টিভি প্রোগ্রাম, ফেসবুক ও ইউটিউবের কল্যাণে হুজুগে বাঙালী জানতে পারল এক অপার সম্ভাবনার পাখির কথা।
বাঙালিরে আর ঠেকায় কে?
শুরু হয়ে গেল টার্কি টার্কি রব। একযোগে খামার করা আর ডিম-বাচ্চা বেঁচে রাতারাতি পয়সাওয়ালা হওয়ার ধান্দা।

অসম্ভব রকমের রমরমা চলছিল টার্কির ব্যবসায়।
কিন্তু কথায় আছেনা ভাল সময় বেশীদিন স্থায়ী হয়না। ২০১৮সালের শুরু হতে হঠাৎই ছন্দপতন ঘটলো। ক্রমবর্ধমান উৎপাদনের সাথে তাল মিলিয়ে ভোক্তা তৈরি না হওয়ায় টার্কির দাম কমতে শুরু করলো।

আসলে আমরা জাতি হিসাবে খুবই অপরিণামদর্শী। নবাব সিরাজ উদদৌলার পতন তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ৷ নবাবকে যখন ইংরেজ বাহিনী টেনে হিছড়ে মারার জন্য নিয়ে যাচ্ছিল, তখন পাশে থাকা হাজারো বাঙালী হাত গুটিয়ে বসে ছিল। ইতিহাস হতে জানা যায় সেই সময় উপস্থিত বাঙালিরা যদি ০১টা করে ঢিলও ছুড়তো তবে ইংরেজ বাহিনী নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। তা না করে হাত গুটিয়ে বসে থাকার পরিণামে মেনে নিতে হয়েছিল দুইশত বছরের গোলামী।

*টার্কির দাম কমতে থাকায় শুরু হলো হুজুগে বাঙালির আরেক হুজুগ-বাজার তৈরির চেষ্টা না করে। হাত গুটিয়ে বসে থেকে রব উঠিয়ে দিল- টার্কি গেল রসাতলে, তারাতারি যা আছে সব বেঁচে দিয়ে পিঠ বাঁচাও।
পরিস্থিতি এমন হবে সেসম্পর্কে গত চার বছর আগেই লেখক তার লেখনির মাধ্যমে হুজুগে বাঙালীদের সচেতন করার বৃথা চেষ্টা করেছে।

পাঠক এবার ভাবতে পারেন ইতিহাসের সাথে ছাগলের সম্পর্ক কি?
লেখক বলছি- হা পাঠক অবশ্যই সম্পর্ক আছে। সময় বয়ে যায় বটে কিন্তু ইতিহাস আমাদের জন্য শিক্ষা রেখে যায়।
হাল সময়ে তিনটি নতুন হুজুগের উদয় হয়েছে আমার সোনার বাংলায়-
(১) দেশী মুরগি পালন
(২) ছাগল পালন
(৩) বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ।

দেশী মুরগি নিয়ে ইতিপূর্বে অনেক লেখা লিখেছি এবং আমার ইউটিউব চ্যানেল Shokher Khamar এ অনেক ভিডিও দিয়েছি। ছাগল নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোন লেখা লিখিনি। যদিও আমার ইউটিউব চ্যানেলে “উদ্যোক্তা উন্নয়ন” পর্বগুলোর অধিকাংশই ছাগল পালন নিয়ে। ইদানিং কালে ফেসবুক লাইভও করার চেষ্টা করছি। তারপরও নুতন উদ্যোক্তাদের আরেকটু চিন্তার খোরাক যোগাতে ছাগল নিয়ে আজকের এই লেখা।

এই সময়ে বাংলাদেশে কিছু দায়িত্বজ্ঞানহীন অর্থলোভী ইউটিউবার এবং কিছু নৈতিকতা বিবর্জিত খামারী পরিচয়ে পরিচয়দানকারী চোরাকারবারী একটি বিশেষ বিকৃত মুখের অবাণিজ্যিক ছাগল নিয়ে হুজুগ ছড়াচ্ছে।

দির্ঘদিনন প্রবাস জীবন যাপনকারী কিংবা দেশে থেকেও প্রবাসীর মত নিজের এলাকা হতে দূরে কর্মরত চাকুরিজীবী অপরিণামদর্শীরা বানিজ্যিকতা না বুঝেই এইসব ইউটিউবার এবং হাজীসাহেব মার্কা চোরদের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে পিপিলিকার মত ঝাপিয়ে পরছে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে এইসব ছাগল দিয়ে খামার করতে।

নতুনরা আকৃষ্ট হবেইনা বা কেন ?
কাটলে মাংস হবেনা ১০কেজি অথচ একটা বাচ্চা বিক্রি হচ্ছে ৩০-৪০হাজার টাকায়। আবার পূর্ণ বয়সী ফিমেল ছাগল বিক্রি হচ্ছে ৫০-৭০ হাজার টাকায়, আর মেল ৮০হাজার হতে দুই লক্ষ টাকায়।

হা পাঠক আপনাকেই বলছি আপনি যদি সৌখিনতার বশে ছাগল পালন করতে চান তাহলে আপনি ভালো লাগার জিনিসটা লক্ষ টাকা খরচ করে কিনতে পারেন। কারন শখের কোন দাম হয়না। বাংলায় প্রবাদ আছে- শখের তোলা ৮০টাকা।
কিন্তু আপনার চিন্তা যদি থাকে ছাগল পালন করে নিজ ও পরিবারের ভরনপোষণ করা। ছাগল নিয়ে আপনার যদি হয় বাণিজ্যিক খামার করার পরিকল্পনা, তাহলে অবশ্যই হুজুগের বশে আবেগ দিয়ে নয় বিবেক দিয়ে, নিজের মেধা ও মনন দিয়ে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোন ছাগল দিয়ে বাণিজ্যিক খামার করবেন। কারো মিষ্টি কথার প্ররোচনায় নয় পড়াশোনা করে নিজেকে জেনে নিতে হবে কোন জাতের ছাগল গুলো বাণিজ্যিক আর কোন গুলো অবাণিজ্যিক।

আর হ্যা এটাও আপনাকে জানতে হবে ওদারকা মাল এদার করে হাজী সাহেব আপনাকে যে ছাগলটা পিউর বলে দিল আর আপনি লাখ টাকা দিয়ে মনের আনন্দে নিয়ে আসলেন, আসলে সেটা কোন গ্রেডের, কত নম্বরের মাল।

*এবার চলুন একটু অর্থনীতি পড়ি।
যেকোন পণ্য বা সেবা উৎপাদনের বেশ কয়েকটি পর্যায় বা চক্র রয়েছে। এই চক্রের শেষ ধাপ হচ্ছে চূড়ান্ত পণ্য বা সেবা। এসব বিষয়ে আরেকদিন লিখবো ইনশাহ্ আল্লাহ।
আজকে ছোট্ট একটি উদাহারণে সহজে বুঝানোর চেষ্টা করছি। আমাদের দেশের অন্যতম অর্থকরী ফসল হচ্ছে-পাট। এই পাট হচ্ছে পাটজাত পণ্য যেমনঃ কাপড়, ব্যাগ, চট, বস্তা ইত্যাদি তৈরির প্রাথমিক উপকরণ বা কাঁচামাল।

আর কাঁচা পাট হতে তৈরি চূড়ান্ত পণ্য অর্থাৎ কাপড়, চট ইত্যাদিই হচ্ছে চূড়ান্ত পণ্য।
এখন কাঁচা পাট বিদেশে রপ্তানী বা পাটজাত পণ্য উৎপাদন না করতে পারলে কাঁচা পাটের দাম স্বাভাবিক ভাবেই কমে যাবে এটাই অর্থনীতি বলে।

পাঠক এবার ভাবতে পারেন অর্থনীতির সাথে ছাগলের সম্পর্ক কি ?
আসলে শুধুমাত্র ছাগল নয় প্রতিটি জিনিসই যেগুলোর আর্থিক মূল্য আছে সেগুলোই অর্থনীতির আলোচ্য বিষয়।

মোদ্দাকথা হচ্ছে- ছাগলের বাচ্চা বা ছাগল হচ্ছে প্রাথমিক পণ্য বা কাঁচামাল। আর ছাগলের মাংসটা হচ্ছে চূড়ান্ত পণ্য। আপাত দৃষ্টিতে বর্তমান সময়ে ছাগলের বাচ্চার এই উচ্চ মূল্যটাকে বাজার মনে হলেও ভোক্তা পর্যায়ে ছাগলের মাংস পৌছে দেয়াই হচ্ছে প্রকৃত বাজার।
বিনিময় প্রথার সূচনালগ্ন হতেই হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল, ফসলাদী, ফলমুল ইত্যাদি মানুষের জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে এক পণ্যের সাথে আরেক পণ্যের বিনিময় হতো। যুগ যুগ ধরেই ছাগল আমাদের খাবার টেবিলে রসনার তৃপ্তি আনে। কিন্তু বর্তমান সময়ে এদেশে দেখছি এক আজব হুজুগ। আবার এসব হুজুগ সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কথা বলতে গেলেই চলবে আপনার বিরদ্ধে অপপ্রচার আর গালীগালাজ।

পাঠক এবার প্রশ্ন করতে পারেন তাহলে কি উন্নতজাতের ছাগলও মাংস হিসাবে বিক্রি হয়। আমি একবাক্যে বলবো হ্যা। তার আগে আরেকটা প্রশ্ন ?
আপনি যেটাকে উন্নত জাত ভাবছেন, সেটাকি আদৌ কোন উন্নত জাত !!!
তবে ব্রীডিং উপযোগী স্বীকৃত কোন ব্রীডারের দাম সবসময়ই বেশী থাকে। আর সেইসব ব্রীডারের স্ট্যান্ডার্ড একটা প্যারামিটার তাকে। তারমানে এই না যে, নিম্নমানেরে এলোমেলো ক্রস, রিজেক্ট আর অবিশুদ্ধ জাতের ছাগল গুলোই লাখ টাকায় বিক্রি হবে। এটা শুধুমাত্র হুজুগে বাঙ্গালীর এই সোনার বাংলায়ই সম্ভব। আমাদের পাশের দেশের বাঙালীরাও কিন্তু এতটা হুজুগ প্রবণ না।

পাঠক যদি ছাগল পালন নিয়ে বানিজ্যিক চিন্তা করে থাকেন, তাহলে অবশ্যই প্রথমে খুঁজে বের করতে হবে কোন জাতের ছাগল গুলো বেশী Prolific অর্থাৎ উৎপাদনশীল। বাচ্চাদানের ক্ষমতা, মোট মাংসের উৎপাদন, দৈহিক বৃদ্ধির হার, রোগমুক্ত থাকা, সহজ খাবার ও পালন ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি সবকিছু মিলিয়েই আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোন জাতটি আপনার বানিজ্যিক খামারের জন্য উপযোগী হবে।
যাইহোক কিবোর্ড যেহেতু ধরেছি এসব নিয়ে ধারাবহিক ভাবে লিখবোই ইনশাআল্লাহ।

এবার পাঠক আপনাকে আরেকটু চিন্তার খোরাক দিচ্ছি- ধরেন আপনি হাজী সাহেবের কাছ হতে অতি উৎসাহী হয়ে একখানা ৪০কেজি জীবন্ত ওজনের ফিমেল ছাগল ৭০হাজার টাকায় কিনলেন। এখন রিজেক্ট থাকার কারনে হোক অথবা আপনার পালন পদ্ধতির ভুলের কারনে হোক ছাগলটির দুধের বাট নষ্ট হয়েগেল। পাঠক সেটা আপনি কত দামে বিক্রি করতে পারবেন?
কসাই আপনাকে কত টাকা দিবে? এ প্রশ্ন কি করেছেন কখনো!!
কসাই কিন্তু প্রথমেই ছাগলের পিঠে থাবা মেরে ধরে দেখবে মাংস কত কেজি হতেপারে। সেই অনুপাতেই আপনাকে দাম দিবে।

উপরের উদাহারনটি এজন্যই দিলাম ইতোপূর্বে হাজী সাহেবসহ তার অনেক অনুসারীই বলেছে- তারা ঐ বিকৃত ছাগলের রূপ ও গুণে মুগ্ধ। এটা কখনোই মাংসের দামে বিক্রি হবেনা।
তাদের ধারনা জীবনভর তারা ওদারকা মাল এদার করে অথবা বাচ্চা উৎপাদন করবে আর হুজুগে বাঙ্গালীদের বোকা বানিয়ে দুপয়সা কামাবে।

★পবিত্র কোরআনে কারিমে এভাবে বলা হয়েছে যে- ‘জল ও স্থলভাগের যত বিপর্যয় আছে তা মানুষের হাতের কামাই অর্থাৎ এ বিপর্যয়গুলো কিছু অপরিণামদর্শী মানুষের কর্মের ফল।’

পরিশেষে- নতুন-পুরাতন সকল ছাগল পালনকারীকেই বলছি- এখনো যদি সচেতন না হোন, তাহলে কয়েকবছর আগের টার্কি খামারীদের মত আপনাদেরও একই পরিনাম হবে। ডিম আর বাচ্চা বেঁচে লাখ টাকা কামানোর স্বপ্নে বিভোর টার্কি খামারী আর আজকে একটা ছাগলের বাচ্চা ৩০-৫০হাজার টাকা বিক্রয়কারীদের মধ্যে বিশেষ কোন পার্থক্য আমি দেখছিনা। আপনাদের তৈরি এই হুজুগের কারনেই অসংখ্য অপরিণামদর্শী নতুন উদ্যোক্তা নিশ্চিত পুঁজি হারাবে।

আমি জানি আমার এ লেখা প্রকাশের পর পরই আমাকে নিয়ে একটা বিশেষ মহল গালিগালাজ ও ট্রল করবে। তারপরও লিখবো।

পুনশ্চঃ
হুজুগে বাঙালী হবেননা।
……..(চলবে)।
বিঃদ্রঃ পোস্টটি পড়ে উপকৃত হলে কপি নয় শেয়ার করুন।

-চাষী মানিক
পরিচালক
শখের খামার এগ্রো প্রজেক্ট
ও এডমিন
Turkey & Poultry Masters Community School

Please follow and like us:

About admin

Check Also

ছাগলের নিউমোনিয়া

ছাগলের নিউমোনিয়া  সঠিক সময় চিকিৎসা না দিলে ছাগল টিকানো কঠিন হয়ে পরে। লক্ষণ গুলো নিম্ন …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Translate »