Breaking News

সাইলেজ কি এবং সাইলেজ প্রস্তুতকরণের সহজ প্রক্রিয়াঃ

পাঠ ১।

গবাদিপশু পালনে সাইলেজের ব্যবহার শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। এটা এদেশের গবাদিপশু পালন খাতটির উন্নয়নে অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। অনেক ব্যাক্তিবিশেষ এবং প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যেই ব্যাক্তিগত এবং বাণিজ্যিক ভাবে সাইলেজের উৎপাদন শুরু করেছে। তাই খামারী ভাইয়েরা যারা সাইলেজ তাদের গবাদিপশুর খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করার পরিকল্পনা করছেন বা ব্যবহার শুরু করে দিয়েছেন তাদের জন্য ভালো মানের সাইলেজ কোনটা বা কেমন হবে তার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দিক এই পোস্টে আলোচনা করবো।
প্রথমে আমাদের জানতে হবে সাইলেজ কি?
নির্দিষ্ট পরিমাণে অম্লত্ব এবং ক্ষারত্ব বজায় রেখে কাঁচা ঘাস দীর্ঘ সময়ের জন্য সংরক্ষণের প্রক্রিয়াকেই সাইলেজ বলে। সাইলেজ অনায়াসে এক বৎসর সময় পর্যন্ত রাখা যায়। আবার কিছু নির্দিষ্ট এডিটিভ যোগ করে ফারমেন্টেশন ঘটিয়ে সাইলেজের পুষ্টিমান সাধারণ ঘাসের চাইতে অনেক বাড়িয়ে তোলা যায়। একে ই,এম সাইলেজও বলা হয়। কর্ণ বা ভূট্টা সাইলেজের ক্ষেত্রে যদি কর্ণ বা ভূট্টার মিল্কিং স্টেজে ( অর্থাৎ, যে সময় কাঁচা কর্ণ বা ভূট্টার দানা চাঁপ দিলে দুধের মত সাদা রস বেরিয়ে আসে) সাইলেজ তৈরী করা হয় তবে ভূট্টা থেকে বের হয়ে আসা রসে উপস্থিত সুগার বা চিনি ফার্মেন্টেশন ঘটায়। তাই কর্ণ সাইলেজ ব্যবহার করলে গবাদিপশুর দানাদার খাদ্য তূলনামূলকভাবে কম লাগে। যদি অন্যান্য ঘাসের সাইলেজও ই,এম সাইলেজ হয় সেই ক্ষেত্রেও একই রকম হবে। এবার আসা যাক আপনি কিভাবে বুঝবেন আপনার গবাদিপশুর জন্য সরবরাহকৃত সাইলেজের মান ভালো সেই বিষয়ে। আমি ভালো মানের সাইলেজের কিছু মানদন্ড তুলে ধরলাম নীচে কয়েকটি পয়েন্ট আকারে।
* আদর্শ সাইলেজে আদ্রতা বা হিউমিডিটি থাকবে ৬৫%-৭০%। এটা সাইলেজ সরবরাহকারীর কাছ থেকে জেনে নিবেন বা নিজে তৈরী করলে মেপে নিবেন।
* আদর্শ সাইলেজে পি,এইচ লেভেল হবে ৩.৭-৪।
* আদর্শ সাইলেজে ড্রাই মেটার বা ডি,এম থাকবে ২৭%-৩০%।
* ভালো সাইলেজ মুঠো করে চিপ দিয়ে ধরে ছেড়ে দিলে হাতে তেমন লেগে থাকবে না,বুঝবেন আদ্রতা ঠিক আছে। আর হাতে লেগে থাকলে বুঝবেন সাইলেজ অতিরিক্ত আদ্রতাযুক্ত যেটা গবাদিপশুর জন্য মোটেও ভালো হবে না। আবার সাইলেজে একদম শুক্না ঝড়ঝড়ে হলে সেটাও ভালো নয়। খড়ের কাজ করবে শুধু!
* সাইলেজ শুঁকে দেখবেন সেটার গন্ধ কেমন! মিষ্টি গন্ধ হলে বুঝবেন সেটা ভালো মানের সাইলেজ আর টক গন্ধ হলে বুঝবেন সাইলেজের মাণ খারাপ।
আজ এই পর্যন্ত সাইলেজ সম্পর্কিত কথাবার্তা। আশা করছি, এই আলোচনা থেকে খামারী ভাইয়েরা আদর্শ সাইলেজের কেমন হতে পারে সেই সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা হলেও পাবেন। একদম সহজ ভাবে ব্যাপারটি তুলে ধরেছি, জটিল শব্দভান্ডারে না যাওয়ার চেষ্টা করেছি! আপনারা বুঝলেই আমার পোস্ট লেখা স্বার্থক।

সাইলেজ প্রস্তুতকরণের সহজ প্রক্রিয়াঃ
—————————————————-

১৯৯৫ সালে সাভার মিলিটারি ফার্মে স্বচক্ষে সাইলেজ তৈরী করতে দেখেছিলাম আমি এবং সাভার ডেইরী ফার্ম থেকে প্রশিক্ষণ শেষ করে বাসায় ফিরে ছোট্ট একটা প্লাস্টিকের ড্রামে আমি সাইলেজ তৈরী করেছিলাম। সেই তৈরী করা সাইলেজ আমার খামারের গাভীগুলি ভালো ভাবেই খেয়েছিল এবং ফলাফলও ভালো পেয়েছিলাম। আবার ২০১৬ থেকে বাণিজ্যিকভাবে সাইলেজ তৈরী করেছিলাম বৃহৎ পরিসরে কিন্তু তারপর থেকে শুধু নিজের গরুগুলির জন্য অল্প কিছু ভুট্টা এবং জার্মান ঘাসের সাইলেজ তৈরী করছি নিয়মিত। যখন সর্বপ্রথম করেছিলাম তখন হয়তো এনসাইলিং একদম পারফেক্ট ভাবে হয়তো হয়নি কিন্তু এখন সেটা নখদর্পনে চলে এসেছে। আপনারাও যারা প্রথম প্রথম শুরু করবেন তাদের আমার মতোই অবস্থা হবে। যেহেতু সাইলেজ এখন শুধু কাঁচা ঘাস সংরক্ষণের প্রক্রিয়াই শুধু নয়, এটা এখন গবাদিপশুর জন্য অধিক পুষ্টিকর খাদ্য হিসাবে সারাবিশ্বে সমাদৃত! আপনারা হয়তো জেনে অবাক হবেন ভালো মানের সাইলেজে ড্রাই মেটার ব্যাসিসে ১৫ মেগাজ্যুল/কেজি এনার্জি বা শক্তি এবং ১৬% পর্যন্ত প্রোটিন থাকে! তাই এখন সব খামারীর উচিৎ তাদের গবাদিপশুর খাদ্য তালিকায় সাইলেজ অন্তর্ভুক্ত করা এবং সাইলেজ প্রস্তুতকরণের প্রক্রিয়াটি শিখে নেওয়া। আসুন,এবার আমরা মূল আলোচনাতে যাই।
*সাইলেজ তৈরী করার জন্য নির্ধারিত ঘাস জমি থেকে কখন কাটবেন এবং কোন পর্যায়ের ঘাস কাটবেন ?
আসলে ভালো মানের সাইলেজ তৈরী করতে হলে উপরের প্রশ্নটার উত্তর জানা খুবই জরুরী! আমি বিস্তারিত আলোচনায় যাবো না শুধু এটুকু বলছি রৌদ্রজ্জ্বল দিনে জমি থেকে সাইলেজের জন্য নির্ধারিত ঘাস বা ভুট্টা গাছ যেটাই হোক না কেন সেগুলি কাটবেন। কারণ তখন সেগুলিতে ময়েশ্চার কন্টেন্ট কম থাকে,যেটা সাইলেজ তৈরীর ক্ষেত্রে খুব সহায়ক। আর মোটামুটি ভাবে ম্যাচিওর বা পরিপক্ক ঘাস কাটবেন।
* কতটুকু আকারে ঘাস কাটবেন বা চপিং করবেন,কখন করবেন এবং কাটার সময়ে কি ধরণের সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে?
জমি থেকে ঘাস বা ভুট্টা গাছ কেটে আনার পর অন্তত ৩/৪ ঘন্টা পর চপিং করবেন বা কাটবেন। ঘাস ১.৩-২.৬ সেন্টিমিটার বা ০.৫-১ ইঞ্চি এই মাপে কাটবেন বা চপিং করবেন। মনে রাখবেন সাইলেজের জন্য ঘাস কখনো মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়া বা কুয়াসার মধ্যে চপিং করবেন না বা কাটবেন না! ঘাস চপিং করার সময় যাতে না থেতলায়।
* চপিং করা ঘাসে কিভাবে এডিটিভ মিশাবেন ফারমেন্টেশন বা গাজন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য?
একমাত্র ভুট্টাসহ ভুট্টা গাছের এবং পাকচং ঘাসের সাইলেজ প্রস্তুত করতে ফারমেন্টেশনের জন্য এডিটিভ দিতে হয় না! চপিং করে সরাসরি সাইলো পিটে অথবা প্লাস্টিক ব্যাগে ঢুকানো যায়। বাকী অন্যান্য ঘাসের সাইলেজ তৈরীতে এডিটিভের প্রয়োজন পরে। আমি এডিটিভ হিসাবে চিটাগুড় মিশ্রিত পানিকেই ব্যবহার করেছি সবসময় ( ১ লিটার পানিতে ২০০ গ্রাম চিটাগুড়)। চপিং করা ঘাসের টুকরার স্তর করে সাজিয়ে এর উপর চিটাগুড় মিশ্রিত পানি ভালো ভাবে ছিটিয়ে দিবেন,যাতে ঘাসের টুকরাগুলি চিটাগুড় মিশ্রিত পানির সংস্পর্শে আসে।
*কিভাবে এডিটিভ মিশানো চপিং করা ঘাস সাইলোপিট বা প্লাস্টিক ব্যাগে এনসাইলিং প্রক্রিয়ার জন্য ঢুকাবেন?
সাইলেজ আমরা দুই ভাবে করতে পারি। একটা হলো সাইলোপিটে এবং অপরটি প্লাস্টিকের ব্যাগে (এয়ার প্রুফ বা বায়ু নিরোধী)। সাইলো পিট দুইভাবে করা যেতে পারে। উচু জায়গায় মাটিতে আয়তাকার গর্ত খুরে তাতে পলিথিন বিছিয়ে করা যায়, আবার ইট,সিমেন্টের তৈরী হাউজে করা। পিটে যদি সাইলেজ তৈরী করেন তাহলে চপিং করা এডিটিভ মেশানো ঘাসগুলি পলিথিন বিছানো মাটির গর্তে বা হাউজে চেপে চেপে ঢুকাতে হবে এবং শেষে মাটির গর্তের উপরে আবার পলিথিন দিয়ে ঢেকে তা মাটি চাপা দিয়ে দিবেন,আর হাউজে ভরলে হাউজের মুখও এমন ভাবে আটকাতে হবে যাতে বাইরে থেকে বাতাস না ঢুকে! এই গেলো পিটে সাইলেজ তৈরীর প্রক্রিয়া। এবার আসুন যদি আমরা প্লাস্টিক ব্যাগে সাইলেজ কিভাবে করবো তা নিয়ে আলোচনা করি একটু। প্লাস্টিকের ব্যাগটা অবশ্যই এয়ারপ্রুফ এবং তূলণামূলকভাবে মোটা হতে হবে যাতে সেটা ছিদ্র হয়ে বা ছিঁড়ে না যায় চপিং করা ঘাস ব্যাগে ঢুকানোর সময়। চপিং করা ঘাস গুলি যতটা সম্ভব হাত দিয়ে চেপে চেপে ঢুকাতে হবে এবং ঢুকানো হয়ে গেলে একট্য ভ্যাকুয়াম এয়ার পাম্প দিয়ে ব্যাগের ভিতরে থাকা বাতাস টেনে বাইরে বের করে দিয়ে ব্যাগের মুখটা শক্ত করে বেধে দিতে হবে যাতে বাইরে থেকে বাতাস না ঢুকে। পিটে বা ব্যাগে যেভাবেই সাইলেজ করুন না কেনো কিছু শুকনা খড়ের টুকরা সাইলেজে ব্যবহার করলে সাইলেজের মান খুব ভালো হয়। এবার অপেক্ষার পালা সাইলেজ তৈরী হওয়ার!
* সাইলেজ তৈরী হতে কত দিন সময় লাগে?
সাধারণত সাইলেজ তৈরীর সমস্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে ২১ দিন সময় লাগে। পিটে বা ব্যাগে ঢুকানোর ২১ দিন পর সাইলেজ সম্পূর্ণ ভাবে তৈরী হয়ে গবাদিপশুকে খাওয়ানোর উপযোগী হয়ে যায়।
* আদর্শ সাইলেজে ড্রাইমেটার এবং পি,এইচ এর পরিমাণ কতটুকু?
আদর্শ মানের সাইলেজে ড্রাই মেটার ২৫%-৩০% এবং পি,এইচ(PH) ৫.৫-৬।
* সাইলেজ প্রক্রিয়াটিতে বায়ুনিরোধক বিষয়টি জরুরী কেনো?
আসলে চপিং করা ঘাসগুলিকে যদি বায়ুনিরোধক ব্যবস্থার মধ্যে রাখা না হয় তাহলে ঘাসের মধ্যে থাকা সুগার বা চিনির নিঃসরণ সঠিক ভাবে হয় না ফলে ল্যাক্টিক এসিড তৈরী হয় না। যার কারণে ফারমেন্টেশন প্রক্রিয়াটিও ব্যহত হয়। এছাড়া বাইরে থেকে কোন কারণে যদি বাতাসের অনুপ্রবেশ ঘটে তাহলে সাইলেজে ছত্রাকের সংক্রমণ ঘটে সমস্ত সাইলেজ পঁচে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে।
* ভালো মানের সাইলেজের রঙ কেমন হয়?
ভালো মানের সাইলেজের রঙ সাধারণত কি ধরনের গ্রীণ ফডার দিয়ে সাইলেজ তৈরী করা হয়েছে সেটার উপর নির্ভর করে। তবে আদর্শ সাইলেজের রঙ হাল্কা সবুজ,হলুদ বা বিবর্ণ খয়েরী রঙ বিশিষ্ট হয়।

 


collected: from Mukty Mahmud ( পি ডি এফ)

Please follow and like us:

About admin

Check Also

গরু মোটাতাজাকরণে ‘ফারমেন্টেড কর্ন’ তৈরীর প্রণালী

গরু মোটাতাজাকরণে ‘ফারমেন্টেড কর্ন’ তৈরীর প্রণালী খামারি ভাইয়েরা বলে, “খড় তো নয় যেন সোনা খাওয়াচ্ছি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Translate »