মহিষ অন্যতম গৃহপালিত স্তন্যপায়ী। মহিষ মুখ্যত উত্তর গোলার্ধের এক প্রজাতি এবং চেহারায় গরুর সঙ্গে কিছুটা মিল রয়েছে। উত্তর আমেরিকার বাইসনকে (bison) অনেক সময় মহিষ বলা হলেও প্রকৃত মহিষের সঙ্গে এদের কোন সম্পর্ক নেই।
মহিষ
এশিয়ার মহিষ বা জলমহিষ (Bubalus bubalis) এশিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব দেশসমূহে বিস্তৃত এবং এ অঞ্চলেই এটি বহুকাল আগে থেকেই গৃহপালিত প্রাণী হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। কোন কোন দেশে মহিষকে এখনও বন্যপ্রাণী হিসেবে দেখা যায়, যেমন নেপাল, আসামসহ ভারতের মধ্যপ্রদেশ ও অন্যান্য কতক এলাকা, মিয়ানমার এবং বোর্ণিও। গৃহপালিত হবার পর কতক বন্য পবিবেশে ফিরে গেছে এমনটি ঘটেছে শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়সহ আরও কয়েকটি দেশে।
জলমহিষ ভারী এবং মজবুত দেহের অধিকারী। এরা উচ্চতায় ১.৮ মিটার পর্যন্ত হতে পারে। দেহের রং ধূসর কালো, পৃষ্ঠভাগ সোজা এবং দেহ অল্প পরিমাণ খাটো লোমে আবৃত। এদের শিঙ বৃহৎ, গোড়ার অংশ বাইরের দিকে এবং শীর্ষপ্রান্ত একে অন্যের দিকে ফেরানো। প্রস্থচ্ছেদে শিঙ দেখতে ত্রিভুজাকার। গৃহপালিত মহিষের জাতগুলির মধ্যে আকার, দেহের গড়ন এবং শিঙের আকার-আকৃতির বিস্তর পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। স্ত্রী মহিষ গর্ভধারণের ১০ মাস পর একটি শাবক প্রসব করে।
মহিষকে প্রধানত একটি ভারবাহী প্রাণী হিসেবে এবং দুধ ও মাখনের জন্য গৃহে লালন পালন করা হয়। ভারত ও পাকিস্তানে বেশ কয়েকটি উন্নত জাতের মহিষ রয়েছে।
এগুলি স্থানীয়ভাবে রাভী ( Ravi ), কুন্ডি (Kundi) এবং নিলী (Nilee) নামে পরিচিত। দুধ উৎপাদন শিল্পে এরা বিশেষ স্থান দখল করে আছে। মহিষের দুধে মাখনের পরিমাণ শতকরা ৬ থেকে ১০ ভাগ।
বাংলাদেশে দুধের জন্য উন্নত জাতের কোন মহিষ নেই। হাল-চাষ ও গাড়ি টানার জন্য চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী জেলার চরাঞ্চলে এবং দেশের উত্তর এলাকার রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর এবং বগুড়া জেলায় মহিষ পালন করতে দেখা যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (১৯৯৮)-এর হিসাব অনুযায়ী এদেশে বর্তমানে প্রায় ৪,৫৭,০০০ মহিষ রয়েছে।
আধুনিক পদ্ধতিতে মহিষ পালন ও পরিচর্যা:
একসময় গ্রামাঞ্চলে গরুর বিকল্প হিসেবে মহিষ পালন করা হতো। বিশেষ করে মালবোঝাই গাড়ি টানতে কৃষকরা গরুর চেয়ে মহিষের ওপরই বেশি নির্ভর করতেন। মহিষ যে শুধু গাড়িই টানে তা নয়; এ থেকে উপাদেয় দুধ এবং মাংস পাওয়া যায়। এর গোবর জৈব সারের একটি উৎকৃষ্ট উৎস। এর হাড় থেকে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী যেমন: বোতাম, চিরুনি ইত্যাদি তৈরি করা যায়, তেমনি এ থেকে পশুখাদ্য ও সার পাওয়া যায়। গরুর তুলনায় মহিষের বার্ষিক বৃদ্ধির হার বেশি। এর কারণ হলো মহিষের রোগ প্রতিরোগ ক্ষমতা অনেক বেশি এবং প্রতিকূল আবহাওয়ায় এরা অনায়াসে বাঁচতে পারে। গরুর বিকল্প হিসেবে মহিষ পালনের সুবিধা বিভিন্ন দুগ্ধজাত খাদ্যপণ্য উৎপাদনের জন্য মহিষের দুধ তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি উপযোগী। গরুর চেয়ে আকারে বড় হওয়ার কারণে মহিষ থেকে অপেক্ষাকৃত বেশি মাংস পাওয়া যায়। শস্য উৎপাদনে কর্দমাক্ত জমি চাষের জন্য গরুর চেয়ে মহিষ বেশি উপযোগী। এ ছাড়া এক জোড়া মহিষ এক জোড়া গরুর তুলনায় অনেক বেশি জমি চাষ করতে পারে। মহিষের জাত মহিষকে প্রধানত দুভাগে ভাগ করা যায়। জলাভূমির মহিষ ও নদীর মহিষ। জলাভূমির মহিষ সাধারণত কাজ করার জন্য ব্যবহার করা হয়। নদীর মহিষ কৃষিকাজসহ অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া দুধ উৎপাদনের জন্যও ব্যবহার হয়ে থাকে। এদের মোট ১৮টি জাত আছে। এর মধ্যে নিলি রাভী, মুররাহ, সুরটি, জাফরাবাদি, মেহসানা, কুনদি, ভাদোয়ারি এবং ইতালীয় ভূ-মধ্যসাগরীয় মহিষ উল্লেখযোগ্য। মহিষের যতœ এবং ব্যবস্থাপনা মহিষ পালন করে আশানুরূপ উৎপাদন পেতে হলে সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং উপযুক্ত পরিচর্যা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও সঠিক পরিচর্যার ওপর নির্ভর করে অধিক উৎপাদন। সুতরাং অধিক উৎপাদন পেতে হলে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তাপমাত্রার প্রতিকূল অবস্থা থেকে পরিত্রাণের লক্ষ্যে মহিষ দিনে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা পর্যন্ত পানিতে শরীর ডুবিয়ে রাখে। আর এ শরীর ডুবিয়ে রাখাকে বলা হয় ওয়ালোয়িং। ওয়ালোয়িংয়ের ব্যবস্থা করা সম্ভব না হলে এদের শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য দিনে তিন-চারবার পরিষ্কার পানি ছিটানো প্রয়োজন। পাইপের মাধ্যমে পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। অন্যান্য প্রাণীর মতো মহিষের বেঁচে থাকার জন্য খাদ্যের প্রয়োজন। সঠিক মাত্রায় উৎপাদন পেতে হলে মহিষের জন্য পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্য জরুরি। এদের খাদ্যতালিকায় দুই ধরনের খাদ্য যেমনÑ আঁশযুক্ত খাদ্য ও দানাদার খাদ্য অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সাধারণত ১০০ কেজি ওজনের একটি মহিষের জন্য ২.০-২.৫ কেজি শুষ্ক পদার্থের প্রয়োজন হয়। এই শুষ্ক পদার্থ আঁশযুক্ত ও দানাদার খাদ্য থেকে সরবরাহ করতে হবে। সুতরাং মহিষের খাদ্য ও পুষ্টি সম্পর্কে প্রত্যেক মহিষ খামারির বা পালনকারীর পরিষ্কার ধারণা থাকা প্রয়োজন। মোট শুষ্ক পদার্থের তিন ভাগের দুভাগ আঁশযুক্ত খাদ্য এবং তিন ভাগের এক ভাগ দানাদার খাদ্য এবং তিন ভাগের এক ভাগ তাজা আঁশযুক্ত খাদ্য অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। উল্লেখ্য, আদি আঁশযুক্ত খাদ্য যদি লেগুম জাতের হয়, তবে এর পরিমাণ যথাক্রমে চার ভাগের তিন ও চার ভাগের এক ভাগ হতে পারে। আঁশযুক্ত খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে উন্নত জাতের ঘাস যেমনÑ নেপিয়ার, বাজরা, অ্যারোসা, পারা ইত্যাদি বহুবর্ষজীবী ঘাস চাষ করা যেতে পারে। এ ছাড়া প্রসবকালীন মহিষের বিশেষ যতœ নিতে হবে। প্রসবের তিন দিন আগে থেকে ভুসি এবং চিটাগুড়সমৃদ্ধ ল্যাক্সোটিভ এবং হালকা রসদ খাওয়াতে হবে। বাচ্চা প্রসবের জন্য প্রকৃতপক্ষে দুই ঘণ্টা সময়ের প্রয়োজন হয়। এ সময় অতি সতর্কতার সঙ্গে দৃষ্টি রাখতে হবে। প্রথম বাচ্চা প্রসবকারী গাভী এক বা একাধিক বাচ্চা প্রসবকারী মহিষের তুলনায় বেশি বিচলিত থাকে। সুতরাং প্রথম বাচ্চা প্রসবকালে গাভীর কাছে না থেকে দূরে থেকে লক্ষ রাখতে হবে। বাচ্চা প্রসবের পর পরই গাভীর শরীরের পেছনের অংশ কুসুম গরম পানি দ্বারা ভালোভাবে পরিষ্কার করে দিতে হবে। পানির সঙ্গে খুব অল্প পরিমাণে লবণ অথবা জীবাণুনাশক মিশিয়ে নেওয়া উত্তম। যদি বাচ্চার থলে না ফাটে তবে অতি দ্রুত ভেটেরিনারি ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। বাচ্চা প্রসবের পর পরই গাভীকে কুসুম গরম পানি খাওয়াতে হবে। এরপর ভুসি, গম ভাঙা অথবা কর্ন, গুড়, লবণ, আদা এবং সামান্য পরিমাণ খনিজজাতীয় খাদ্য উপাদানের সমন্বয়ে জাউ করে খাওয়াতে হবে। এতে গাভীর পেট পরিষ্কার হবে এবং শরীরের শক্তি ফিরে আসবে। বাচ্চা প্রসবের চার-ছয় ঘণ্টার মধ্যে ফুল বের হয়ে আসে। ফুল বের হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সরিয়ে নিয়ে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। লক্ষ রাখতে হবে যাতে গাভী কোনোক্রমেই এ ফুল খেয়ে ফেলার সুযোগ না পায়। বাচ্চার জন্মের পর বিশেষ যতœ নিতে হবে। কারণ সঠিক যতœ ও উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা বাচ্চার উৎপাদন দক্ষতা বৃদ্ধি করে। তবে ভালো ব্যবস্থাপনায় সাধারণত ১৮-২০ মাস বয়সেই প্রথম বাচ্চা ধারণ করে এবং ২৮-৩০ মাস বয়সে প্রথম বাচ্চা প্রসব করে এবং দৈহিক ওজন ৩০০ থেকে ৩৫০ কেজি হয়ে থাকে। মহিষের বাসস্থান গরুর তুলনায় মহিষের জন্য বাসস্থান নির্মাণে তেমন কোনো খরচ হয় না। কারণ গরুর মতো মহিষের জন্য ব্যয়বহুল ঘর তৈরির প্রয়োজন নেই। মহিষ সাধারণত ছায়ায় থাকতে পছন্দ করে। সুতরাং পারিবারিকভাবে অল্পসংখ্যক মহিষ পালনের ক্ষেত্রে অতি ঠা-া ও গরমের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ছাউনি তৈরি করা যেতে পারে। এ ছাউনি গাছের নিচে বা ছায়াযুক্ত স্থানে নির্মাণ করাই উত্তম। ছাউনি তৈরির উপকরণ হিসেবে বিভিন্ন অঞ্চলে সহজপ্রাপ্য উপকরণ যেমনÑ ছন, নারিকেল গাছের পাতা, পাটের সোলা ইত্যাদি ব্যবহার করা যায়। মহিষের সংখ্যা বেশি হলে খামারে আধাপাকা ঘর তৈরি করা যেতে পারে। সঙ্গে ঘরের মেঝেটাও পাকা করা ভালো। প্রতিটি ঘরে ড্রেন বা নালা থাকতে হবে এবং ড্রেনগুলো সরিয়ে নেওয়া যায় এমন স্লাব তৈরি করে ঢেকে দিতে হবে। ড্রেনগুলো অগভীর হবে। ঘরের ছাদ টিন, বাঁশ, করোগেটেড সিট অথবা ইট দিয়ে তৈরি করা যেতে পারে। উদম অনাচ্ছাদিত জায়গায় ছায়াদানকারী গাছ লাগানো যেতে পারে, যা পশুকে শীতকালে সরাসরি ঠা-া বাতাস এবং গরমকালে সূর্যের তাপ থেকে রক্ষা করবে। গাভীর ঘরের এক পাশে খাবার ও পানি সরবরাহের ব্যবস্থা রাখতে হবে। বাকি তিন দিক পাঁচ ফুট উঁচু করে দেয়াল তৈরি করতে হবে। ঘরের সামনে উন্মুক্ত (ছাদবিহীন) জায়গায় তিন ফুট উঁচু দেয়াল দিয়ে চারদিক বন্ধ করে একপাশে গেট রাখতে হবে। পর্যাপ্ত আলো-বাতাস চলাচলের জন্য মেঝে থেকে তিন ফুট উঁচুতে ৬বাই৩ ফুট মাপের জানালা রাখতে হবে।
আরো তথ্যের জন্য সাথে থাকুন।
অর্গানিক এগ্রো ফার্ম এন্ড হ্যাচারী,খুলনা।০১৯১৪-৬৫৫৪১০ ০১৭৩০-৮৮৮-৯৮২