গির জাতের গরুর পরিচিতি
গরুর নাম :
বস ইন্ডিয়াকাস জাতের ইন্ডিয়ান যে গরুটি পৃথিবীব্যাপী সবচে বেশি জাত উন্নয়নের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে সেটাই হচ্ছে গ্রীষ্মন্ডলীয় চরম আবহাওয়ার গরু ‘গির’ বা গুজরাটি বা দেশান।
ইন্ডিয়ান নিজস্ব জাত গুলোর মধ্যে সবচে ভালো ডুয়াল পারপাস ( দুধ ও মাংস) গরু হচ্ছে আমাদের আজকের গরু।
ব্রাহমা ছাড়াও এটাকেও ইন্ডিয়ার পবিত্র গরু বলে মনে করা হয়।
গড় ওজন : ষাঁড় : ৫৫০ – ৭০০ কেজি।
গাভী ৪০০-৪৫০ কেজি।
উৎস দেশ :
ইন্ডিয়ার গুজরাটের সৌরাষ্ট্র এবং পার্শবর্তী ‘গির’ জঙ্গল এলাকার গরু বলেই জঙ্গল এর নাম এর সাথে মিল রেখে এটার নামকরণ হয়েছে ‘গির’।
তবে গুজরাটের আদি গরু হলেও পৃথিবীর এমন কোনো গরু পালনকারী শীতপ্রধান বা উষ্ণমণ্ডলীয় দেশ নাই যেখানে গির বা গির থেকে উন্নয়ন করা গরু পালন করা হয় না।
এমনকি আমেরিকাতে উন্নয়ন করা যে ব্রহ্মা বা ব্রাহমা মাংসের গরু জনপ্রিয় হয়েছে সেটাও উন্নয়ন করা হয়েছে উনিশ শতকে ব্রাজিলে গির, কংকরেজ আর অঙ্গল থেকে উন্নয়ন করা ‘ইন্দুব্রাজিল’ থেকে।
ইন্ডিয়ান ইন্ডিজেনাস জাতের গরু হলেও এখন পৃথিবীতে গিরের সবচে বেশি জনপ্রিয়তা ব্রাজিলে।
ইন্ডিয়াতে এক গবেষণায় দেখা গেছে বর্তমানে গুজরাটে যেখানে ৫০০০ ইন্ডিজেনাস গির রয়েছে সেখানে ব্রাজিলে রয়েছে ৫ মিলিয়ন এর অধিক গির জাতের গরু।
ইতিহাস :
গির ইন্ডিয়ার অতি পুরানো গরু এবং গুজরাট এবং পার্শবর্তী অঞ্চলে হাজার বছর ধরে পালন করা হলেও কবে থেকে পালন শুরু হয়েছে এর সঠিক ইতিহাস পাওয়া যায় না।
তবে ধারণা করা হয় ৩০০০ বছর পূর্ব থেকে এই জাতের গরু গুজরাটের গির জঙ্গল এর পার্শবর্তী অঞ্চলে পালন করা হয়।
পরবর্তীতে এটা ইন্ডিয়ার অন্যান্য অঞ্চলে দুধের গরু হিসাবে বিস্তার লাভ করে।
পাকিস্তানী ডুয়াল পারপাস সবচে ভালো গরু সাহিওয়াল এবং লাল সিন্ধির সাথে প্রতিযোগীতা করে গির ইন্ডিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে এখনো ডুয়াল পারপাস গরু হিসাবে টিকে রয়েছে।
ব্রাজিল ১৮৫০ সালে অন্ধ্র প্রদেশ থেকে অঙ্গল এবং গুজরাট থেকে গির এবং কংকরেজ জাতের গরু আমদানি করে সেখানে গিরের জাত উন্নয়ন করা হয়। এছাড়া পরবর্তী বিভিন্ন দেশ তাদের জাত উন্নয়নের জন্য গির গরু আমদানি করে।
পালনকারী দেশ এবং সংখ্যা :
যদিও গির ইন্ডিয়ার ইন্ডিজেনাস গরু কিন্তু পৃথিবীর সবচে বেশি গির পালন করা হয় ব্রাজিলে।
ইন্ডিয়াতে বিশুদ্ধ গিরের সংখ্যা মাত্র ৫ হাজার। উনিশ শতকে ব্রাজিলে গির, কংকরেজ আর অঙ্গল থেকে উন্নয়ন করা ‘ইন্দুব্রাজিল’ মাংসের জন্য একটা বিখ্যাত জাত।
এছাড়া ১৯৭৬ সালে ব্রাজিল তাদের নিজস্ব ‘মোকো ন্যাশনাল’ গরুর সাথে ক্রস এর মাধ্যমে যে নতুন ‘রেড পোল ক্যাটল’ নামের দুধের জাত সৃষ্টি করেছে, এটাই সেখানে প্রকৃত গির নামে পরিচিত।
ব্রাজিলে বর্তমানে ৫ মিলিয়ন গির গরু পালন করা হয়। ব্রাজিল ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের নামিবিয়া, জাম্বিয়া, কেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা সহ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে গির অথবা গির থেকে উন্নয়ন করা গরু পালন করা হয়।
কোথাও মাংসের জন্য আবার কোথাও দুধের জন্য জাত উন্নয়নে এই জাতের গরু ব্যবহার করা হয়।
বৈশিষ্ট ও সুবিধা :
গারো লাল গিরের প্রধান রং হলেও হালকা হলুদাভ ও সাদা রঙের হয়ে থাকে।
এছাড়া কালো রং এর গির ও দেখা যায়। মোটা এবং পিছনে দিকে বাঁকানো সিং এবং চওড়া কপাল গিরের চেহারাতে আভিজাত্যের ছাপ এনে দিয়েছে। চওড়া কপাল অতি উষ্ণ আবহাওয়াতে গিরের শরীর ঠান্ডা করার রেডিওটর হিসাবে কাজ করে।
লম্বা ঝুলানো কান এবং জেবু জাতের গরুর মধ্যে সবচে উঁচু চুট গির গরুতে এনে দিয়েছে সৌন্দের্যের এক বিশেষ মাত্রা। গির গরু উষ্ণ এবং আদ্র আবহাওয়াতে খুব ঘাম দেয়।
যার ফলে তাপ নিয়ন্ত্রণ এবং বিভিন্ন প্রকার পরজীবী নিয়ন্ত্রণ নিয়ন্ত্রণ এই জাতের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট। জেবু জাতের গরুর মধ্যে সবচে শান্ত এবং অনুগত গরু হিসাবে পরিচিত গির মানুষের সাথে ঘনিষ্ঠ থাকতে পছন্দ করে।
এই জাতের ষাঁড় গরু পুরো গরুর পালের নিরাপত্তা প্রহরী হিসাবে কাজ করে। অত্যন্ত রোগ প্রতিরোধী এই জাতের গরু পালন খুবই সহজ এবং যেকোনো খাবারে এরা অভ্যস্ত।
গির জাতের গরু ২০-২৪ মাসে প্রথম প্রজননক্ষম হয় এবং গাভী ৩০-৩৪ মাসে প্রথম বাচ্চা দেয়।
দুধ ও মাংস উৎপাদন :
ইন্ডিয়াতে গিরের গড় দুধ উৎপাদন ১৬০০-১৮০০ কেজি হলেও ৩১০০ কেজি দুধ উৎপাদনের রেকর্ড ইন্ডিয়াতে রয়েছে।
ইন্ডিয়া তে ‘হিরাল’ নামের গির গরুর এক উৎপাদন সময়ে ৮২০০ লিটার দুধ দেয়ার রেকর্ড রয়েছে।
তবে ব্রাজিলে গির জাতের গরুর গড় দুধ উৎপাদন ৩০০০-৩২০০ কেজি। এবং সেখানে ‘শিরা’ নামের এক গির গরুর ৬২ লিটার দুধ দেয়ার রেকর্ড রয়েছে। এই জাতের গাভী ৪ মাস পর্যন্ত দুধ উৎপাদন ঠিক থাকে। এরপরে দুধ উৎপাদন দ্রুত কমে যায়।
তবে কমে গেলেও ২৮০-৩০০ দিন পর্যন্ত দুধ উৎপাদন চলতে থাকে।
তবে ছোট উৎপাদনকাল এবং গাভীতে সিমেন দেয়ার পর দ্রুত দুধ কমে যাওয়া দুধ উৎপাদনের গরু হিসাবে এই জাতের প্রধান সমস্যা। তবে উচ্চমাত্রার ফ্যাট এবং A2 মিল্ক প্রোটিন সমৃদ্ধ গিরের দুধ খুবই সুস্বাদু।
অন্যান্য জেবু জাতের গরুর মতো এই জাতের গরুতে রয়েছে ৪.১ -৪.৯ মাত্রার ফ্যাট এবং প্রায় সময় পরিমান মিল্ক প্রোটিন।
আর এই জাতের ষাঁড় বড় জাতের হয়ে থাকে এবং মাংস সুস্বাদু হওয়ায় চাহিদা ও বেশি। যে বৈশিষ্ট্য ‘গির’ কে জেবু জাতের অন্য গরু থেকে শ্রেষ্ঠত্ব এনে দিয়েছে সেটা হলো দ্রুত শারীরিক বৃদ্ধি।
গির বাছুর খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
অর্থনৈতিক গুরুত্ব :
যেহেতু গির জাতের গরু ভালো মানের এবং উচ্চ প্রোটিন ও ফ্যাট যুক্ত A2 দুধ উৎপাদন করে তাই এই জাতের দুধের রয়েছে উচ্চমূল্য এবং অধিক চাহিদা।
এছাড়া এই জাতের গরুর মাংস ও যেহেতু খুব সুস্বাদু এবং ষাঁড় এর সাইজও ও যেহেতু বড় হয়ে থাকে, তাই মাংসের জন্য গির পালন লাভ জনক।
তবে এই জাতের সবচে বেশি গুরুত্ব যে কারণে সেটা হলো জাত উন্নয়ন। আমাদের দেশে যতগুলো বড় খামার আছে, যারা জাত উন্নয়ন করেছে, তাদের প্রত্যেকের কাছে এই জাতের গরু আছে।
কারণ গির এর সাথে উন্নয়ন করা ফ্রিজিয়ান বা জার্সি জাতের গাভী উপমহাদেশের অন্য যেকোনো জাতের গভীর চেয়ে শক্ত, রোগ প্রতিরোধী, অধিক ও উন্নত মানের দুধ, দেখতে সুন্দর এবং সাইজ ও বড় হয়ে থাকে। গির একটি উচ্চ প্রজননক্ষম গরু।
বস ইন্ডিকাস জাতের অন্য গরুর জন্য যেখানে গড়ে ১.৬ টা সিমেন স্ট্রিপ দরকার হয়, সেখানে এই জাতের জন্য দরকার হয় গড়ে স্ট্রিপ দরকার হয় ১.৩ টা।
এই জাতের গরু যেহেতু বস ইন্ডিকাস জাতের মধ্যে সবচে উচ্চ প্রজননক্ষম, তাই একটি গির গাভী জীবনকালে গড়ে ১২ টি বাচ্চা দেয়।
‘গির’ গরু পালনে সমস্যা :
গির যেহেতু উপমহাদেশের বস ইন্ডিকাস জাতের গরু তাই দুধ উৎপাদনকাল ইউরোপের বস টোরাস জাতের ক্রস এর চেয়ে ছোট এবং দুধ উৎপাদন কম লাভজনক।
এছাড়া এই জাতের গরু ইউরোপের ক্রস জাতের গরুর চেয়ে প্রথম বাচ্চা দিতে ৪ মাস সময় বেশি লাগে।
ক্রস জাতের গরু যেখানে ২৮ মাসের মধ্যে প্রথম বাচ্চা দেয় সেখানে এই জাতের সময় লাগে ৩০-৩৪ মাস।
জীবনকাল :
একটি গির গরুর গড় জীবনকাল সাধারণত ২০-২২ বছর।
এই জাতের গরু যেহেতু বস ইন্ডিকাস জাতের মধ্যে সবচে উচ্চ প্রজননক্ষম, তাই একটি গির গাভী জীবনকালে গড়ে ১২ টি বাচ্চা দেয়।