ঢাকার ক্রেতারা কিপ্টে!
গত কয়েকদিন ধরে সামাজিক গনমাধ্যমে কোরবানীতে অবিক্রিত বড় গরু নিয়ে বেশ সোরগোল। ঢাকায় বিক্রি করতে নিয়ে আসা বেশ কয়েকটি বড় গরু খামারিরা কাংখিত দাম না পেয়ে হতাশ হয়েছে। আমরা অনেকেই তাদের আবেগী ভিডিও ধারন করে ছড়িয়ে দিয়েছে ফেসবুকে, অনেক অনেক লাইক পেয়েছি, শেয়ার পেয়েছি। পোস্টদাতা ও ইউটিউবার খুব খুশী এত্ত এত্ত লাইক আর শেয়ার দেখে, বাড়তি কিছু আয়ও হলো তাদের ভিউ বাড়িয়ে।
অথচ একজনকে দেখলাম না বলতে বা গঠনমূলক কিছু তথ্য তুলে ধরতে কেন আমাদের এই প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিরা বড় গরু বিক্রি করতে পারেনি তার যথাযথ একটা ব্যাখ্যা দিতে। উল্টো দেখা গেছে খামারিরা নিজেদের মধ্যে একজন আরেকজনকে খোচানো ও হেয় করার চেস্টায় ব্যাস্ত। লজ্জা লাগে আমার নিজেকে কিছু নোংরা মানসিকতার মানুষদের পাশে দাড় করাতে।
একটা ঘটনা শেয়ার করি……
২০১৭ সনে রাজশাহী জেলায় নিলফামারীর একজন খামারি একদিন আমাকে ফোন করে বললেন ওনি ৮/১০ টা বেশ কিছু বড় বড় সাইজের গরু তৈরী করেছেন যা বিক্রি করতে পারছেনা।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কার পরামর্শে এত বড় সাইজের গরু তৈরী করেছেন? ওনি বললেন, ভাই কারো সাথে কথা বলিনি। ঢাকার ওমুক একটি বড় খামারে একদিন ভিজিট করে দেখলাম বড় সাইজের গরু, দেখে ভাল লাগলো তাই করলাম।
পাঠক বলুন আপনি, একজন বিনিয়োগকারী যে কিনা লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে তার কি কি করনীয় বা ভাবার ছিল বিনিয়োগ করার আগে? ঢাকায় খামার দেখে যে নীলফামারিতে ঢাকার আদলে গরু তৈরী করে সে কি একবারের জন্য ভেবেছে তার এলাকার ক্রেতা কারা? ঢাকার ক্রেতা তার গরু কেন কিনবে? আর্থিক সামর্থ শুধু থাকলে হবেনা, ২০ লাখ টাকা অর্থ ব্যয় করবে এমন মানসিকতা সম্পন্ন ক্রেতাও বা আছে ক’জন তার এলাকায়?
উপরন্তু ঢাকার ক্রেতাদের মানসিকতার ও অনেক পরিবর্তন এসেছে। অনেকে সুস্থ ও সুন্দরভাবে লালন পালন করা গরু একটু বেশী দাম হলেও নিজে খামার ভিজিট করে দেখে কিনতে চায়। সেক্ষেত্রে হাটে অজানা একজন বিক্রেতার থেকে দামী একটি গরু কেনার থেকে ঢাকায় খামার ভিজিট করে গরু কেনাকে বেশী প্রায়রিটি দিয়ে থাকে৷ ঢাকার খামারিরা গরু নিজ খরচে বাড়ি পৌছে দেয়া, বিক্রয়ের পর সেবাদান সহ বাড়তি কিছু সুযোগ সুবিধা দিয়ে থাকে। এটাও ঢাকার খামার থেকে গরু ক্রেতাদের জন্য বাড়তি পাওয়া।
প্রায়ই আমাকে কিছু খামারি ভাইরা ফোন করে বলে, ভাই ঢাকার ওমুক বড় খামারে ভিজিট করতে চাই, শিখতে চাই ওনি গরুকে কি খাওয়ায়, কিভাবে লালন পালন করে? আমি এরপর প্রশ্ন করি৷ আপনার বাজেট কত খামারে বিনিয়োগের জন্য? উত্তর দেয়, ভাই আমি ছোট খামারি ৩/৪ টা ফ্যাটেনিং গরু নিয়ে শুরু করবো!
আমি উত্তরে বললাম, আপনি ছোট খামারি হলে চেস্টা করুন আপনার আশেপাশে আপনার মত ছোট বিনিয়োগ করে কে কিভাবে ব্যবসা করছে তা বোঝার।
একটি দুগ্ধ খামার দেবার আগে আমরা অনেকে একবারের জন্য ভাবিনা আমার এলাকায় খামারের উতপাদিত দুধের ক্রেতা কে? বাজারে দুধের চাহিদা ও যোগান কেমন? দুধের দাম কেমন আছে? লোকসান আপনি করবেন না তো কে করবে?
ভুলগুলো আসলে আমরা এখানেই করে থাকি। ইউটিউবে দেখলাম একজন খামার করে কোটিপতি, ২৫ লাখ টাকায় গরু বিক্রি করেছে, ব্যাস হিসাব নিকাশ ছাড়াই ঝাপ দিয়ে দিলাম। ইউটিউবার এসব আকর্ষণীয় আবেগী ভিডিও দেয় ভিউ বাড়িয়ে দুটো পয়সা ইনকাম করার উদ্দ্যেশ্য, আর আপনি আমি তো দেখি লাভ আর লাভ।
যেকোন বিনিয়োগ করার আগে বাজার সম্পর্কে সম্পূর্ন ধারনা আগে নিয়ে আপনাকে বিনিয়োগ করতে হবে।
আসাযাক ঝিনাইদহ থেকে আনা যুবরাজ নামক ৩৫ লক্ষ টাকা গরুর ব্যাপারে। খামারির জন্য খারাপ লেগেছে ভেবে যে ওনি তার প্রিয় গরুটি বিক্রি করতে পারেনি। গরুটির ওজন ওনি ২০০০ কেজি বললেও এটি নিয়ে সংশয় আছে। কারন আমরা যারা এই সেক্টরের সাথে জড়িত, আমরা যেকোন গরুর দিকে তাকিয়ে বলে দিতে পারবো গরুটির ওজন কেমন হতে পারে। সাধারন মানুষের পক্ষে তা বোঝা সম্ভব নয়। তবে ইদানিং অনেক বড় বড় খামারে ডিজিটাল স্কেলের মাধ্যমে গরু ওজন দিয়ে লাইভ ওয়েট একটা নির্দিষ্ট দামে বিক্রি করে থাকে।
এখন বিক্রেতা যদি হাটে নিয়ে তার ৯০০ কেজির গরুকে ২০০০ কেজি বলে কিছু করার নেই। মিডিয়া বা সাধারন জনগন সেটাই তুলে ধরবে।তথ্য পাবলিকলি সত্যটাই শেয়ার করা উচিত।
প্রতিযোগিতামূলক বাজারে কে কতদামে বিক্রি করবে বা করতে পারলো তা নির্ভর করে সম্পূর্ন তার বিক্রেতার বিক্রয় কৌশলের উপর। ২৫ লাখ টাকায় গরু যিনি তৈরী করবেন এমন সিদ্ধ্যান্ত নেবার আগে খামারিকে ভাবতে হবে ২৫ লাখ টাকায় গরু কেনার মত ক্রেতা আপনার আছে কিনা। বাজারজাতকরন কৌশল, রিলেশনশীপ, কানেকশন এগুলোর প্রভাব অনেক বিক্রয় ব্যবস্থাপনায় যা আমরা অনেকি চিন্তা করিনা।
গত ৫ বছরে ক্যাটল সেক্টরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ঢাকায় ও তার আশেপাশে অনেক অনেক খামার তৈরী হয়েছে যাদের লক্ষ্যই হচ্ছে ঢাকার ক্রেতা। এই বছর ঢাকা বিভাগে প্রায় ৩ লাখ গরু জবাই হয়েছে, এর মধ্যে ১% ক্রেতা নেই যারা ১.৫০ লাখ টাকার উপরে গরু কিনেছে। অধিকাংশের বাজেট ৬০ হাজার থেকে ১ লাখের মধ্যে। ঢাকা বিভাগে খামারের সংখ্যা প্রায় ৫৫ হাজার যা ৫/৭ বছর আগে ছিল মাত্র ১৫ হাজারের মত।
আমরা যারা ঢাকার বাইরে থেকে ২৫ লাখ টাকার গরু নিয়ে আসছি ঢাকার হাটে বিক্রি করতে আমরা কি এসব একবারের জন্য বিবেচনা করি বা জানি কি পরিবর্তন এসেছে? তারা কি জানে ঢাকার বাজারে ক্রেতার পছন্দ কি? ফ্রিজিয়ান বড় গরুর চাহিদা ভাল নাকি শাহীওয়াল লাল গরুর চাহিদা বেশী? আমরা অনেকেই এসব বোঝার চেস্টা করিনা।
ঢাকার বাজার দখল করবে ঢাকা ও তার আশেপাশের সকল খামারিরা এটাই স্বাভাবিক। অনলাইনে বিক্রয় হয়েছে প্রায় ১২ হাজার গরু এবারের কোরবানীতে। প্রতি বছর ১৫% থেকে ২০% করে বাড়ছে অন লাইন বিক্রয়। এসব খোজ রাখি কয়জন আমরা!
৩/৪ দিন আগে একজন খামারি রাগ আর ক্ষোভে ফেসবুকে প্রচার করলো ঢাকায় ও তার আশেপাশের বড় খামার বন্ধ করে দেয়া হোক!
এটা কি সম্ভব কোনভাবে? পাগলের প্রলাপ ছাড়া কিছুই নয়। ঈর্ষান্বিত না হয়ে আমাদের উচিত সঠিক ব্যবসায়ীক পলিসি নিজের জন্য তৈরী করা। কিভাবে খাদ্য খরচ কমানো যায়, নিজের এলাকায় কি চাহিদা, ক্রেতার মনোভাব তা বোঝা দরকার এবং সেই মোতাবেক বিনিয়োগ ও গরু তৈরী করা।
প্রতিযোগিতা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আপনি কি ঢাকার ১% বড় ক্রেতা ধরবেন নাকি ৯৯% এভারেজ দামের ক্রেতা ধরবেন সেটা নির্ভর করবে আপনার বিচক্ষণতা ও ব্যবসায়ীক কৌশলের উপর।
যুবরাজের দাম ২৭ লক্ষ টাকা দাম ওঠার পরেও খামারি তা বিক্রি না করে ভুল করেছে বলেই আমি মনে করি।
আমার মতে ঢাকার বড় খামারিদের থেকে প্রান্তিক পর্যায়ের খামারিরা অনেক কম খরচে গরু তৈরী করতে পারে এবং লাভও বেশী করতে পারে। খামারিদের কম খরচে গরু তৈরীর সঠিক নিয়মগুলো জানতে হবে।
পাশাপাশি খামার করে কোটিপতি হয়েছে, ২ টা গরু থেকে ২ বছরে ১০০০ গরুর মালিক এসব আবেগী পোস্ট/নিউজ পড়ে ব্যবসাতে ঝাপ দেবার আগে নতুন উদ্যোগক্তাদের বলবো বাংলাদেশ ডেইর ফার্মারস এসোসিয়েশন অফিসে (https://www.facebook.com/bmmpa) এসে সঠিক পরামর্শ নিয়ে যাবেন খামারে বিনিয়োগ করার আগে।
ধন্যবাদ
জেনারেল সেক্রেটারি
বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস এসোসিয়েশন