Breaking News

বিষাক্ত রতিগাছ পরিচিতি

Toxic plant Roti

সাইদুল ইসলাম মন্টু
কুঁচ বরন কন্যা, তার মেঘ বরন কেশ…
সুন্দরী কন্যার রূপ বর্ননায় দুধ সাদা আর কালো চোখওয়ালা কুঁচ ফলের মত গায়ের রঙয়ের উপমা দিয়েছেন কবি।নতুন প্রজন্ম হয়ত এ নামের সঙ্গে পরিচিতও নয়। পৃথিবীতে এই অদ্ভুত সুন্দর চোখওয়ালা রতি কুঁচ ফল সাদা, কালো সহ নানা রঙয়ের হলেও সবচেয়ে বেশি পাওয়া ‌যায় লাল কুঁচ(Abrus precatorius)। কালের গর্ভে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে এই কুঁচ।

সবচেয়ে বেশি পাওয়া ‌যায় লাল কুঁচ(Abrus precatorius)।
উপমহাদেশের আদিবাসী এই লতার অনুপম বৈশিষ্ট্য হল এর বীজ। গাছ যেমনই হোক, দুর্বল অথবা স্বাস্থ্যবান, কিংবা পত্রাবলী পোকায় খাওয়া, ফলের ভিতর যে ক’টা বীজ পুষ্ট হবে তার সবক’টাই হবে সমান ওজনের। ওজনের এই নিত্যতার কারণে রতি কুঁচ দিয়ে আগে সোনা মাপা হতো। অসাধারণ শক্ত বলে কলাবতীর মতো এর বীজও মারাক্কাস জাতীয় ঝুমঝুমি বাদ্যযন্ত্রে ব্যবহার করা হয়। দু একটা স্যাকরার দোকানে এগুলো এখনও হয়ত অ্যান্টিকের মতো শোভা পায়। তবে ডিজিট্যাল ওজন মেশিন আসার পর থেকে রতিকুঁচ দিয়ে আর ওজন করা হয় না। সোনার মাপে ৯৬টি কুঁচের ওজন ১ ভরির সমান। ১ ভরিতে ১৬ আনা, ১ আনায় ৬ কুঁচ। অর্থাৎ হালকা ৩ আনা সোনার কানের দুল মাপতে কুঁচ লাগত ১৮টা।

ত্রিনিদাদ, ওয়েস্ট ইণ্ডিজ প্রভৃতি এলাকায় এই রতি কুঁচকে মাঙ্গলিক হিসাবে গলায় বা হাতে পরা হয়।
গয়না তৈরিতে এই কুঁচের দারুণ সমাদর, বিশেষত আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকায়। ত্রিনিদাদ, ওয়েস্ট ইণ্ডিজ প্রভৃতি এলাকায় এই রতি কুঁচকে মাঙ্গলিক হিসাবে গলায় বা হাতে পরা হয়। তামিলরা নানা রঙ মিলিয়ে একে মালা ও ব্রেসলেট হিসাবে পরে, কিছু এলাকায় চওড়া মাজারবিছারের চল আছে। বিভিন্ন ধর্মে জপের মালা হিসাবেও এই কুঁচ ফলকেই ব্যবহার করা হয়। শত শত বছর ধরে তামিলরা

কিছু মানুষ ব্যবসায়িক ভিত্তিতে নেকলেস ও জপমালা তৈরি করে।
এই গাছ এবং এর ব্যবহার সম্পর্কে জানে, বিশেষত ‘সিদ্ধা’ চিকিৎসায় এর যথেষ্ট প্রসার আছে। এই গাছের শিকড়, পাতা, বীজ সবকিছুই বিষাক্ত, বীজই সবচেয়ে বেশি। ‘রাইসিন’ নামক ভেন্না-বিষের তুলনায় এর বিষাক্ততা ৭৫ গুণ বেশি। আগে রতি কুঁচের বিষাক্ততা সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান ছিল সীমিত। কিছু মানুষ ব্যবসায়িক ভিত্তিতে নেকলেস ও জপমালা তৈরি করতো, যা এখনো করে। সুতো পরানোর জন্য বীজকে ছিদ্র করার দরকার হতো। এই সূক্ষ্ম কাজ করতে গিয়ে অসাবধানে হাতের আঙুলে একটু খোঁচা লেগে রক্ত বের হলে রক্তে বিষ মিশে অনেকের মৃত্যু ঘটত। কিন্তু এই মৃত্যু তাৎক্ষণিক ছিল না, কয়েকদিন সময় লাগতো, তাই মানুষ বুঝে উঠতে পারত না, মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিল রতি কুঁচের বিষ। বীজের ভিতরকার ‘এব্রিন’ নামক বিষ রক্তে ঢুকে জীবকোষের প্রোটিন সিন্থেসিস বন্ধ করে দিত বলেই মারা যেত আহত মানুষ। বিষক্রিয়ার কারণ উদ্ঘাটিত হওয়ার পর বিষকে দুধে জ্বাল দিয়ে শোধন করার উপায় বের হয়েছে। মারাত্মক বিষও কখনো প্রয়োজনীয় ওষুধ হিসাবে কাজ করে। হোমিওপ্যাথিতে বেশ সফলভাবে ডিপ্রেশন ও নিদ্রাহীনতার জন্য একটি ‘ট্রাঙ্কুইল ড্রাগ’ তৈরি হয় যার সঙ্গে অ্যাকোনাইট, বেলাডোনা জাতীয় বিষজ ওষুধ মেশানো হয়।

অদ্ভুত সুন্দর চোখওয়ালা রতি কুঁচ ফল সাদা, কালো সহ নানা রঙয়ের হয়
কুঁচ সম্পর্কে অথর্ববেদের বৈদ্যককল্প শুক্তিতে এর উল্লেখ ‘শাঙ্গুষ্ঠা’ নামে, যে নাম চরক সংহিতায় প্রথম দিকে উল্লিখিত হলেও পরে তা বদলে গিয়ে ‘গুঞ্জা’ হয়েছে। সংস্কৃত এবং হিন্দিতে ব্যবহৃত শব্দ হলেও ‘গুঞ্জা-মালা’র সঙ্গে আমাদের সাহিত্য-পরিচয় আছে। আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসায় সাধারণত সাদা কুঁচের (Abrus fruticulosus) ব্যবহারই প্রধান যার বীজের ফলনও শিম প্রতি ৯-১২ টা যেখানে লাল বীজের ফলন মাত্র ৩-৫টা। চর্মরোগ, শ্লেষ্মা, শিরোরোগ, কৃমি, শূলব্যথা নিবারণে, কেশ রঙ করতে এবং ‘আফ্রোডিসিয়াক’ হিসাবে এর ব্যবহার আছে আয়ুর্বেদে। উপমহাদেশের বাইরে এই গাছ টিটেনাস, জন্ডিস, ব্রঙ্কাইটিস, যক্ষা, একজিমা, পেটের পীড়া, ডায়েবেটিস, স্কিন ক্যান্সার ইত্যাদি নানা অসুখে ব্যবহার হয়েছে।

কুঁচ সম্পর্কে অথর্ববেদের বৈদ্যককল্প শুক্তিতে এর উল্লেখ ‘শাঙ্গুষ্ঠা’ নামে
রতি কুঁচ দেশি লতানো গাছ, ইংরেজিতে এর প্রচলিত নাম রোজারি পি (Rosary pea) অর্থাৎ মটরদানার মতো। দেশজ এই লতা হিমালয়-গাত্র থেকে শুরু করে দক্ষিণ ভারত হয়ে শ্রীলঙ্কাতেও দেখা যায়। পাতা দেখতে তেঁতুল পাতার মতো যার ২০-৪০টি উপপত্র থাকে। সকন্টক, বহুবর্ষজীবী পত্রমোচী গাছ, বয়স বাড়লে কাণ্ড শক্ত ও কাষ্ঠল হয়ে ওঠে। শিকড় গভীর ও চোষক মূলের উপস্থিতির কারণে কোনো কোনো পরিবেশে এদের অতিবিস্তার ঘটতে পারে। হাওয়াইতে একে আগ্রাসী উদ্ভিদ হিসাবে গণ্য করা হলেও আমাদের উপমহাদেশে তেমন নয়। ডিজিট্যাল ওজন ‌যন্ত্রের দাপটে রতি কুঁচের ব্যবহার কমে‌ গেলেও পৃথিবীর বিভিন্ন চিকিৎসাশাস্ত্রের আচার্য ও বিজ্ঞানীরা মানব কল্যাণে এর বিষাক্ত বীজ থেকে মূল্যবান ওষুধ বানানোর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।

Please follow and like us:

About admin

Check Also

সহজভাবে গরুর খাবার উৎপাদন /ব্যবস্থা করার সিস্টেম

লিখেছেন মিজানোর রহমান (পিডিএফ গ্রুপ) কিছু কদু গাছ লাগাইছি, বুড়ো পাতা গরুরে খাওয়াব… কিছু কলাগাছ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Translate »