Breaking News

গরুর উৎপাদন ব্যয় কমানোর কৌশলঃ

গরুর উৎপাদন ব্যায় কমাোনর কৌশলঃ

১) আপনি কোথায় থাকেন?
এই প্রশ্ন আর উত্তর নিষ্ঠুর কিন্তু অত্যাবশ্যকিয়। যদি আপনি এমন জায়গাতে থাকেন যার দুই কিঃমিঃর মধ্যে বিনা পয়সায় ঘাস পাওয়া যায়, তাহলে আপনার উৎপাদন ব্যায় ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ কমে যাবে। আমার যেখানে ঘের ও গোয়াল, তার দুইপাশে লতা, সানা, দূর্বা সহ অন্যান্য দেশী ঘাসের ছড়াছড়ি। আমিত নেইই, কাছের অন্য এলাকার মানুষও এসে কেটে নিয়ে যায়। পাশের গ্রামের সব গরুগুলো সারাদিন খেয়ে গোধূলিতে নাদুসনুদুস হয়ে ঘরে ফেরার দৃশ্য প্রাই প্রতিদিনই উপভোগ করি। আমার দেশের গো’সম্পদে সয়ংসম্পূর্ণ হবার সপ্ন আমি দেখি এই গোধূলিতেই, কর্পোরেট কংক্রিট সর্বোস্ব দেয়ালের মধ্যে কখনোই নয়। কেননা খোদার কসম, আমার জানা নেই আপনাদের এই কংক্রিট নিয়মে কোন দেশ সফলতা পেয়েছে।

২) আপনার কতটুকু জমি আছে?
এটা আরও নিষ্ঠুর প্রশ্ন কিন্তু ততধিক অত্যাবশ্যক। যদি আপনার নিজস্ব গ্রেজিংল্যান্ড অর্থাৎ চারণভূমি থাকে অথবা ফসলের ক্ষেত থাকে, তাহলেও উৎপাদন ব্যায় ৩০ থেকে ১০০ শতাংশ কমান সম্ভব, সেই সাথে বাড়তি আয় সম্ভব। এখানে গরু সাবসিডিয়রি প্রডাক্ট। অর্থাৎ, ক্ষেতের বাই-প্রডাক্ট এর সুষ্ঠ বা লাভজনক প্রয়োগ মাধ্যম। আবার ক্ষেত্রবিশেষে বায়োগ্যাস ও সারের প্রাইমারী কারখানা (গোবর উৎপাদক)।

৩) কি জাতের গরু নিয়েছেন?
ক) খায় কেমন? একেক গরুর খাদ্য চাহিদা একেক রকম এটা সবাই জানে, বড় গরু খাবে বেশী এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ১০০ কেজি খাবার খেয়ে এক জাতের গরু ১৫ কেজি হয় তো আরেক জাতের গরু হয় ১০ কেজি… এক্ষেত্রে জাত নির্বাচন ভাইটাল।
খ) গরুর রোগ-বালাই কেমন? একেক গরুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা একেক রকম। স্থানীয় আবহাওয়া সহনশীলতা ভিন্ন। এমন গরুও এদেশে আছে যা এসির বাতাসে না রাখলে ৬০% প্রডাকশন ড্রপ করে… আবার এমন গরু লাখে লাখে আছে যা এই টিকা সেই টিকা, এই ঔসুদ সেই ঔসুদ ছাড়া বাঁচেনা, বাঁচলেও উৎপাদন দেয় না। আবার এমন গরুও আছে সামান্য যত্নে অল্প খাবারে দিব্যি বেড়ে ওঠে। খেয়াল রাখতে হবে যেন কৃমি না হয়, আর গোয়াল অপরিষ্কার না থাকে।
গ) গরুর দুধ বা গোস্তের মান কেমন? নিষ্ঠুরতার চরম পর্যায়ের প্রশ্ন, কিন্তু এটাই বাস্তবতা। গোস্তের স্বাদ বেশী এমন জাতের গরু হলে মানুষ দুই টাকা বেশী দিয়ে কিনবে, আর স্বাদ না থাকলে ৫টাকা কমে না পাইলে নিবেনা বা আমার মত ঘাড়ত্যাড়া হলেত অর্ধেক দামেও নিবেই না। দুধের মান ও পুষ্টিগুন ভাল হলে বেশি দাম পাবেন, নাহলে পাবেন না।
ঘ) দুধ বনাম আকার কেমন? ১টা ৫০০ কেজি ওজোনের গাভি ১০ লিটার দুধ দেয় আর ১৮০ কেজি ওজোনের গাভি দেয় ৫ লিটার। ফলাফলঃ ১৮০ কেজি ওজোনের গাভি দুধ বেশী দেয়।
ঙ) গরু কি শুদু দুধই অথবা শুদু গোস্তই দেয়? তাহলে এহেন অপদার্থ গরু বর্জনিয়। যেই মুখে দেশ ছোট বলেন সেই মুখে আমার বিরোধীতা করার সুজোগ আপনার নেই, যদি আপনি সত্যবাদি হন।

৪) গরুকে কি খাওয়ান?
এটা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ন প্রশ্ন। প্যাকেট খাবার খাওয়ানোই লাগবে, কে বলেছে? গরুর মূল খাবার ঘাস, খড়। এর সাথে দেবেন ধানের তুষ বা পালিস। খৈল ভুষি দিতে পারলেও ভাল। কিন্তু সবথেকে ভাল হবে ভ্যারাইটি ধরনের ঘাস ও খড় খাওয়ালে। খড় খেলে গরুর গোস্তের উৎপাদন কমে না বরং স্বাদ বাড়ে। আর সবুজ খাবারে বাড়ে পানি, তাই ফোলা ফোলা লাগে। দানাদার খাবারের মধ্যে ভুষি বা পালিস দিতে পারলে দেন, না পারলে দিয়েন না। গরু শুধুমাত্র খড় ধানের তুষ পানি খেয়েই বাড়তে পারে। তবে চেহারা রুগ্ন হবে। এর সাথে লবন আর গুড় দিলে চেহারা মোটামুটি ভাল হয়ে যাবে। আপনারে কম্পানির প্যাকেট খাবার খাওয়াতেই হবে কইছে কোন শালায়? ইউরিয়া মোলাসেস দিলে খরচ কয় কোটি বাড়ে তা আমার বোধগম্য নয়। নিজের জমি নাই? ধানক্ষেত ভুট্টাক্ষেত গমক্ষেত নাই? কাছাকাছি ঘাস খাওয়ানোর মত সূজগ নাই? আমি আপনার জন্য এই পোষ্ট লিখি নাই। লিখছি যাতে দেশের এই খাত বাঁচে সেই জন্য।

৫) কি ঘাসের চাষ করেন?
যেই জমিতে ধান গম ভুট্টা হয়, সেই জমিতে খালি ঘাস লাগায়ে জমির অপচয় করতেছেন কেন? খামার হলে বাচবে দেশ এজাতীয় স্বদেশপ্রেমের বুলি আউড়িয়ে দেশের ১২টা বাজাবেন না প্লিজ। নেপিয়ার জার্মান চাষ করে তো সেই তিন মাসই বসে থাকা লাগে, তাহলে ভুট্টা লাগাতে সমস্যা কোথায়? সূর্যমুখি লাগাতে সমস্যা কোথায়? পুষ্টিমান কম? তো আপনার বিদেশী ঘাসে কি সব আছে? ফালতু ঝগড়া আমরা না করি। থামেন, শুনেন, কোন ঘাস বা খড়েই সবকিছু সঠিক পরিমানে থাকেনা। আপনাকে ভ্যারাইটি খাবার দিতে হবে। এক্ষেত্রে ভুট্টার খড় বা ঘাস, ধান, গম, যব, জই এর খড় বা ঘাস দেবেন। মিশায় দেবেন, না দিতে পারলে যখন যেটা পাবেন সেটা দেবেন। সবুজ হলে এমনিই খাওয়ান, খড় হলে ভাতের মাড়, গুড় আর লবন মিশায়ে দেবেন। মানসম্মত-সাস্থ্যকর উপায়ে ০.০৫% ইউরিয়া দেবেন আর গরুর চেহারায় মন না ভরলে দেশী স্ট্যাইলে না হয় ৪% পর্যন্ত ইউরিয়া দেবেন। মূলা, গাজর সহ বিভিন্ন কোপির ফেলান্তি পাতা, বিভিন্ন ডাল বা সিমের শাক-পাতা, সজিনার পাতা, কলাগাছ মোদ্দাকথা আপনার জমিতে যা চাষ করবেন তার বাই-প্রডাক্ট খাওয়াবেন। একসাথে সব সবুজ খাবার দিলে গরুর পেট পাতলা হতে পারে, তাই অবশ্যই খড় লাগবেই লাগবেই লাগবেই, খড়ের কোন বিকল্প নেই। ভাতের মাড় দেবেন পরিবারের ভাত রান্নার পর যেটা ফেলান্তি যায় সেটা। বেশী দরকার নেই। আর ক্ষুদের যাউ দেবেন না, যদি ভাতের ফ্যান যথেষ্ট না হয়, তখন এই খুদ ফ্যানের মত করেই রান্না করে দেবেন। শুদুমাত্র কিছু চর্বি তৈরির জন্য। বেশী দিলেন তো ঠকেছেন। পেট্ঝোলা পেটমোটা গরু অন্তত আমি মিজানুর রহমান কিনিনা।

৬) জানেন প্যাকেট খাবারে কি থাকে?
আসলে জানার চাইতে না জানাই উত্তম। আমি এগুলো জানি সেই ২০০৫ সাল থেকে। নিজের খামার শুরুর হবার পরেও মাল্টিন্যাশলাল কম্পানির বানানটা খাওয়াই। কেন? কারন সাহসে কুলায় নাই। সামান্য ভূল হয়ে যেতে পারে ভোক্তার জন্য ক্যান্সারের কারন। দেশে এসিআই, স্কয়ার, আকিজ এর মত বড় বড় প্রতিষ্ঠান, যারা শত শত কোটি টাকা ব্যায়ে ফীডের কারখানা করতে পারে, তারা এ সমস্ত নানাবিধ ক্যামিক্যাল ঠিকঠাক অনুপাতে দিতে পারেন। যত্রতত্র গড়ে ওঠা আল-ছালাদিয়া কোম্পানির প্যাকেট মালে যে কি আছে… তা পরীক্ষা ছাড়া বিশ্বাস অসম্ভব।। এজন্য না যে আমি তাদের অবিশ্বাস করি বরং এজন্য যে এহেন বিষয় পরিক্ষা-নিরিক্ষা ও মান-নিয়ন্ত্রণের জন্য তাদের সেই লেভেলের ল্যাবরেটরিত দূরে, কোন ল্যাবেরটরিই নাই। কি খাওয়াচ্ছেন গরুরে তথা মানুষকে? দেখেন, আপনার দুশ্চিন্তাও গেল, খরচও প্রাই পানি পানি এখন।

৭) গরুর গোস্তই কি মূল উদ্দেশ্য?
এটা ৫০% সঠিক আবার ৫০% ভুল। আসলে শুদুমাত্র গোস্তের চিন্তা করলেই কিন্তু ধরাটা খাবেন। আমাদের জানা ও বোঝা উচিৎ গরুর মোট খাবার থেকে মোট উৎপাদন করার ক্ষমতা মাছ বা মুরগী থেকে কম। ফলে আমাদের গরুর পেছনে দামী খাবার ব্যায় করাও বোকামি। কিন্তু কম খরচেই খাবারের মান আমরা বাড়াতে পারি (৫)নং প্যারার ছকে অর্থাৎ ভ্যারাইটি খড় দিয়ে। কিন্তু আমাদের দেশে, বিভিন্ন হালচাষে, মালটানার কাজে ষাঁড় বা বলদের ব্যাবহার শুরু হলে তাতে আমাদের লাভ। গরুর খাবারের খরচ গরু নিজেই কামায় করবে। দুধের গাভিতো মালিককে সেটাই দেয়। আমরা ঝগড়া না করি, দেশে ঘোড়ার গাড়ী ঐতিহ্যের নামে ঢাকা শহরে চললে সমস্যা হয়না আর গরুর গাড়ী চললে যত সমস্যা? না, কখনই নয়, অন্তত ব্রেকছাড়া ঠেলাগাড়ির চাইতে তো ভাল। ঘড়ার গাড়ী দৈনিক চুক্তিতে ভাড়ায় খাটে আর গরুর গাড়ী, যা টন টন মাল টানতে পারে, তা রিক্সা সিএনজির মত ভাড়ায় খাটবে না কে বলেছে? যদি হেগে দেয়? আচ্ছা যান, গোবর ঠেকানর জন্য লাগলে গরুর ডাইপার আমি নিজে আবিষ্কার করে দেব। এইবার খুশি?

আমার দেয়া যে পদ্ধতি, এটাতে কিন্তু গরুগুলো গোল হবেনা। কিন্তু যারা গরু চিনে, তারা বেশী দামে কিনবেন। আবার উৎপাদন খরচ এ নিয়মে এখন এতই কম যে কিছু কম দাম পেলেও লাভ। অথচ দামী জাতের বিদেশী গরু থেকে এই গরুর দামই বেশী থাকে হাটে। আর মানুষজন এখন কোন গরু কেমন তা ইন্টারনেটে দেখে বুঝেই হাটে যায় তা কয়েক বছর হল। এমন সচেতন ক্রেতাদের ঠকান প্রাই অসম্ভব। অতএব বুদ্ধিমান বেক্তিমাত্রই বুঝে গেছেন কেমন গরু পাললে তাদের খরচ কম হবে।

পরিশেষে বলব, অস্ট্রেলিয়াতে গ্রেজিং ল্যান্ডের অভাব নেই, গমের ভুষি প্রাই ফ্রি। ব্রাজিলে সয়ামিল প্রাই ফ্রি। স্পেন চলে দানের টাকায় আর তাদেরও গ্রেজিংল্যান্ড আছে। এজন্য এদের দেশের গরু উৎপাদন ব্যায় প্রাই ফ্রি। কিন্তু ভারতের অবস্তা এমন নয়, তাদের অবস্তা বাংলাদেশের মতই। পাকিস্তানের অবস্তা আরও জঘন্য। কিন্তু এই দুইদেশে গরুর দাম কম কারন তারা গরুর উৎপাদন ব্যায় ফেরত পাওয়ার পদ্ধতি বের করে নিয়েছে। এ দুই দেশে এখনো গৃহস্তরা গরু দিয়েই হালচাষ পছন্দ করে। দিন দিন অবশ্য এগুলো কমে যাচ্ছে, তারপরেও বহু আছে। বাংলাদেশেও অবস্তাও একই রকম, এজন্যেই গ্রামের মালিকেরা হাটে গরু এনে একটা সন্তষজনক দাম পেলেই ছেড়ে দিতে পারেন যা কংক্রিটের মায়াজালে ঘেরা বিশিষ্ট খামারিগন পারেন না। তারা আন্দলোনও করে। সত্যকথা এই যে, ৫০০ টাকার গোস্ত খাওয়ার সামর্থ্য এদেশের জনগনের নাই, তারা আপনাদের ভাল চান, কিন্তু নিরুপাই হলে তারা বাধ্য হয়েই বিকল্প পথে যাবে।
Courtesy : Mizanur Rahman

Please follow and like us:

About admin

Check Also

নবজাতক বাছুরের যত্ন ও করণীয় :

নবজাতক বাছুরের যত্ন ও করণীয় : স্তন্যপায়ী প্রায় সকল প্রাণীর জন্মপ্রক্রিয়া প্রায় একই হলেও কিছু …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Translate »