Breaking News

করোনাযুদ্ধে প্রাণিসম্পদ ডা. মো. নূরে আলম

সম্পাদকীয় কলাম
করোনাযুদ্ধে প্রাণিসম্পদ
ডা. মো. নূরে আলম

বাংলাদেশসহ অনেক দেশেই লকডাউন শিথিল করা হয়েছে। লকডাউন অবস্থা চলতে থাকলে বেকারত্ব, ক্ষুধা, দরিদ্রতা ও অপুষ্টিজনিত কারণে যে ভয়ংকর অবস্থার মুখোমুখি হতে হবে, তা মোকাবিলা করোনার চাইতে কঠিন হবে। এ পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য সচেতন হওয়ার পাশাপাশি পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করে নিজের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো, যাকে বলে ইমিউনিটি। ইউনিসেফ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, এফএও, বাংলাদেশের করোনাযুদ্ধের মুখপাত্র আইডিসিআর, মাইক্রোবায়োলজিস্ট ও চিকিৎসকরা বলছেন বেশি করে দুধ, ডিম, মাংস খেতে; যেগুলোকে তারা বলছে সুপার ফুড। যেগুলোর উৎপাদন ও সরবরাহ নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে প্রাণিসম্পদ দপ্তর।

বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্য, জীবিকা, পুষ্টি, কর্মসংস্থান ও নারীর ক্ষমতায়নের সঙ্গে প্রাণিসম্পদ খাত একসূত্রে গাঁথা। গ্রামাঞ্চলের ভূমিহীন, প্রান্তিক, দুস্থ, বেকার শ্রেণির জীবন্ত ব্যাংক হিসেবে কাজ করে প্রাণিসম্পদ ও পোলট্রি। গত দশ বছরে দেশে দুধ উৎপাদন বেড়েছে প্রায় পাঁচগুণ, মাংস উৎপাদন বেড়েছে প্রায় আটগুণ, ডিম উৎপাদন বেড়েছে চারগুণ। কিন্তু আমাদের যেতে হবে আরও অনেক পথ। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উন্নয়নের মহাসড়কে চলতে প্রাণিসম্পদ বিভাগকে হতে হবে আর আধুনিক, যুগোপযোগী এবং টেকসই উন্নয়ন, যা পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।

মানুষের ৬০ শতাংশ রোগ আসে প্রাণী হতে, ৭০ শতাংশ অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার হয় অ্যানিমেল ও পোলট্রিতে! তার মানে মানুষকে সুস্থ রাখতে ভেট হেলথের জন্য যা বিনিয়োগ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তার সবটুকু উপকার মানুষেই পাবে। কিন্তু আমাদের দেশের চিত্র ভয়াবহ! ২৫০টির বেশি উপজেলায় ভেটেরিনারি সার্জনের পদ খালি। কোনো উপজেলায় ভেটেরিনারি ডায়াগনস্টিক-ল্যাব-ক্লিনিক্যাল সেবা নেই, হাসপাতাল নেই- ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসাসেবা নেই। আবার শুক্র-শনি দুই দিন প্রাণিসম্পদ দপ্তর বন্ধ থাকে; যেন এই দুই দিন ও অফিস টাইমের পর কোনো প্রাণী অসুস্থ হবে না। ফলে একদিকে যেমন সেবাপ্রার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছেন, অন্যদিকে উৎপাদন ব্যাহত হয়ে পুষ্টি নিরাপত্তা পড়ছে হুমকির মুখে।

একদিকে দুধবিহীন কনডেন্সড মিল্কের নামে আমরা বিষ খাচ্ছি, অন্যদিকে প্রতিবেশী ভারত কনডেন্স মিল্ক বাজারজাত করতে না দিয়ে দুধ-চায়ের প্রচলন ঘটিয়ে খামারিদের টিকিয়ে রাখছে।
তারা আমাদের গরু না দিয়ে বিশ্বের সেরা গোমাংস রপ্তানিকারক হওয়ার স্বপ্ন দেখে। আর আমরা ফ্রোজেন মাংস, পাউডার দুধ আমদানি করে দেশীয় খামারিদের পথে বসাচ্ছি। ফলে দেশীয় খামারিরা দুধ, ডিম, পোলট্রি, মাংসের মূল্য না পেয়ে পুঁজি হারাচ্ছেন।

একজন ডাক্তার দিয়েই একটি হাসপাতাল চলবে, একটি উপজেলা চলবে, এই বিধান রেখে প্রায় ২৫ বারের বেশি সংশোধনের পর পাস হতে যাচ্ছে অরগানোগ্রাম। সেখানেও ধরা হয়নি এপিডেমিওলজিস্ট, প্যাথলজিস্ট কিংবা এক্সটেনশন অফিসার পদ, রাখা হয়নি ভেটেরিনারি রেগুলেটরি সার্ভিস, ভেটেরিনারি পাবলিক হেলথ কিংবা এপিডেমিওলজি শাখা! একজন ভেট কীভাবে ডেইরি সেক্টর, পোলট্রি সেক্টর, ক্লিনিক্যাল সার্ভিস সম্প্রসারণ ও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করবেন?

প্রাণিসম্পদ বিভাগকে শত বছর পিছিয়ে রেখে উন্নত বিশ্বের মতো নিরাপদ খাদ্য ও সুস্থ জাতি আশা করা অবান্তর। বিদ্যমান সমস্যাবলি সমাধানে নিল্ফেম্নাক্ত প্রস্তাবগুলো বিবেচনা করা যেতে পারে- অতি দ্রুত ভেটেরিনারি সার্ভিসকে ইমার্জেন্সি ঘোষণা করা, যেন খামারিরা প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টা প্রাণিসেবা পায়। প্রতিটি ইউনিয়নে ভেট নিয়োগ দেওয়া, এতে একদিকে যেমন খামারিরা যথাযথ চিকিৎসাসেবা ও পরামর্শ পাবে, অন্যদিকে প্রাণিজ আমিষ নিরাপদ হবে ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। বহুদিন ঝুলে থাকা জনবল কাঠামো দ্রুত পাস করতে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া ও যুগোপযোগী করা। শক্তিশালী ভেটেরিনারি রেগুলেটরি সার্ভিস নিশ্চিত করা; ভেটেরিনারি পাবলিক হেল্‌থ কার্যক্রম চালু করা। ডেইরি ও পোলট্রি ডেভেলপমেন্ট বোর্ড গঠন করে উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থা আধুনিকায়ন করা। কনডেন্স মিল্ক্ক নিষিদ্ধ করে চায়ে তরল দুধের প্রচলন বাড়ানো। মাংস ও পাউডার দুধ আমদানি নিষিদ্ধ করা। চামড়া শিল্পকে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে আনা। পশুখাদ্যে ভর্তুকি নিশ্চিত করা ও মন্দাকালীন সময়ের জন্য খামারিদের প্রণোদনার আওতায় আনা। প্রান্তিক খামারিদের জন্য বিদ্যুৎ বিল শিল্প থেকে কৃষিতে রূপান্তরিত করা। প্রক্রিয়াজাত পোলট্রি পণ্য, দুধ, মাংস রপ্তানিতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।

করোনা-পরবর্তী সময়ে দেশের পুষ্টি নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য দূরীকরণে অগ্রাধিকার খাত হিসেবে অনস্বীকার্য ভূমিকা পালন করবে প্রাণিসম্পদ খাত। অন্যথায় ভবিষ্যৎ পুষ্টি নিরাপত্তা হুমকিতে পড়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য নিরসন কার্যক্রম অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।

ভেটেরিনারি সার্জন, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, ঢাকা
nurealamdr@gmail.com

Please follow and like us:

About admin

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Translate »