“হাইব্রীড ভিগর” কাহিনী
‘হাইব্রীড’ শব্দটির সাথে আমরা খুব পরিচিত। হাইব্রীড জাতের ফসল, শাক-সবজি, গাছ-গাছালির প্রতি আমাদের দুর্দান্ত আকর্ষণ। এর কারনও আছে- হাইব্রীডে ফলন, লাভ সবই বেশি। এই হাইব্রীড উদ্ভিদ দেশে না এলে বোধহয় খাদ্যাভাব দেখা দিত।
তো উদ্ভিদের ক্ষেত্রে যা হাইব্রীড (তৈরি প্রক্রিয়ার নাম হাইব্রিডাইজেশন), প্রাণীর ক্ষেত্রে এর নাম ক্রসব্রীড (তৈরি প্রক্রিয়ার নাম ক্রসব্রীডিং)। দুইটি উদ্ভিদ প্রজাতির মাঝে সংকরায়ন ঘটালে যে সংকর তৈরি হয় তার নামই হাইব্রীড। কিন্তু মাঝে মাঝে এমন সব সংকর তৈরি হয় যার গুণাবলী তার মাতা-পিতার চেয়েও বেশি। এই সংকরটিই “হাইব্রীড” নামে বাজারে ছাড়া হয়। এই যে গুনাবলী পিতা-মাতার গড় না হয়ে বেড়ে গেল এর নামই ‘হাইব্রীড ভিগর’।
তো ভাই চলুন ডেইরীর ক্ষেত্রে ‘হাইব্রীড ভিগর’ (Hybrid Vigor বা Heterosis বা Outbreeding Enhancement) কি জিনিস তা একটু বোঝার চেষ্টা করি।
আপনি জেবু(যেমন, শাহীওয়াল) ও টরাইনের (যেমন, হলস্টিন) ক্রস ঘটাতে চান। ধরুন আপনি Uecker Supersire Josuper (029HO17553) নামক বুলের সিমেন আপনার ১২ লিটারের শাহীওয়াল গাভীতে দিবেন। তো, Supersire এর EPD চার্ট হতে জানা যায় তার কন্যাদের দুধের গড় প্রতি ল্যাকটেশনে ৩১,৮০৬ পাউন্ড (১৪,৪৫৭ কেজি)।
“একটি গাভী প্রথম দুই মাস সর্বোচ্চ দুধ দেয় এবং পরবর্তী প্রতি মাসে ১০% করে দুধ কমে”- এই হিসাবে Supersire এর কন্যাদের দুধ সর্বোচ্চ ৭২ লিটার। তো সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী এই বাচ্চা (জেবু-টরাইন ৫০%+৫০% যাকে F1 প্রজেনীও বলে) মা’র অর্ধেক (অর্থাৎ ৬ লিটার) ও বাপের অর্ধেক( অর্থাৎ ৩৬ লিটার) পায়- অর্থাৎ দুধের জেনেটিক মেরিট (গুণ) পাবে ৩৬+৬= ৪২ লিটার।
কিন্তু দেখা যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই ৪২ লিটারের চেয়েও কিছু বেশি মেরিট চলে আসে। যেমন ৪২ এর জায়গায় ৪৪/৪৫ হয়ে যায়।
(বাস্তবে আপনি ৪৪/৪৫ লিটার দুধ তৃতীয় বিয়ানে পাবেন কিনা তা শুধুমাত্র জেনেটিক মেরিট নয় বরং শাল দুধ খাওয়ানো, আদর-যত্ন, ম্যাস্টাইটিস, বায়োসিকিউরিটি, খাদ্যাভ্যাস, সুস্থতা, পরিবেশ ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক বিষয়ের উপর নির্ভর করে।)
ধরে নেই, এই F1 প্রজেনী (অর্থাৎ এই ৫০%+৫০% বাচ্চা) দুধের জেনেটিক মেরিট পেল ৪৪ লিটার। এবার একে ৭৫% সিমেন দিতে হবে।
(এই ২৫%+৭৫% সিমেনের মানও যদি শাহীওয়াল ১২ লিটার, হলস্টিন ৭২ লিটারের বাচ্চার মানের হয়, তবে জেনেটিক মেরিট হবে(৩+৫৪)=৫৭ লিটার। এ ধরনের ৭৫% বা ৩/৪ ষাড় ব্রাজিলে আছে)।
৭৫% সিমেন দেয়ার ফলে বাচ্চা মার কাছ থেকে পাবে ২২ (৪৪/২) লিটার ও বাপের কাছ থেকে পাবে ২৮.৫ (৫৭/২) লিটার। অর্থাৎ এই ৩৭.৫%+৬২.৫% বাচ্চার (যা F2 প্রজেনী নামেও পরিচিত) দুধের জেনেটিক মেরিট হবে (২২+২৮.৫)=৫০.৫ লিটার। এক্ষেত্রে অবশ্য হাইব্রীড ভিগর আসবে না। কারন হাইব্রীড ভিগর কেবলমাত্র পিওর ব্রীডের মাঝে ( ২ বা ততোধিক) ক্রসব্রীডিং এর সময় আসে– F1xF1 এ আসেনা।
(এখন বাস্তবে ৫০.৫ লিটারের কতটুকু কাছাকাছি আপনি যেতে পারবেন তা নির্ভর করে আপনার দক্ষতা ও খামার-ব্যাবস্থাপনার উপর। আমরা তো ভাই ঘাস বাদ দিয়া হাইড্রোপনিক খুঁজি আর চারটা দানা খাদ্য বেশি দেই!!!)
দেশীয়-শাহীওয়াল-হলস্টিনের Three way ক্রসব্রীডিং এও ‘হাইব্রীড ভিগর’ আসে। ব্যাখ্যাটা অনেক লম্বা— শুধু জেনে রাখুন আসে।
এবার ‘হাইব্রীড ভিগর’ কি জিনিস বুঝলেন তো?
ভাই, এই যে হাইব্রীড ভিগর (দুধ ২/৩ লিটার বাড়ে) এটি দুধের ক্ষেত্রে যতটুকু- তারচেয়েও বেশি পাওয়া যায় প্রজনন ক্ষমতা, গাভীর প্রজননক্ষম থাকার সময়কাল, আয়ু, শক্তিমত্তা, ওজন, কম বাচ্চা মৃত্যুহার ইত্যাদি গুনাবলীর ক্ষেত্রে। খেয়াল করে দেখবেন- শাহীওয়াল ৩০ মাসে ও হলস্টিন ১০ মাসে হীটে আসলেও এদের F1বাচ্চা গড় ২০ মাসে না এসে বরং ১২-১৪ মাসেই হীটে আসে। এটাও কিন্তু ‘হাইব্রীড ভিগর’। যদিও ১৮ মাসের আগে সিমেন দেয়া ঠিক নয়।
অতএব ‘হাইব্রীড ভিগর’ ক্রসব্রিডারদের (আমরা যারা খামারী) জন্য আল্লাহর তরফ থেকে নেয়ামত।
বিভিন্ন রকম ক্রসব্রীডিং পদ্ধতি ( যেমন two way, three way, four way, rotational cross breeding) এ কোনটির ক্ষেত্রে কতটা হাইব্রীড ভিগর পাওয়া যায়- এসব জটিল আলোচনায় যাব না। শুধু এটুকু বলব ১০০% এর পিছনে না দৌড়িয়ে ৬২.৫% এর পথে আসুন। এখানেই কাংখিত উৎপাদন ও শক্তি-সহিষ্ণুতার সর্বোচ্চ মেলবন্ধন সম্ভব। পারসেন্টেজ বাড়াইতে বাড়াইতে ইন্ডাস্ট্রিটা আজ ধ্বংসের পথে।
হাইব্রীড ভিগর বনাম ইনব্রীডিং:
অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারেন- “ভাই, এত যে হাইব্রীড ভিগরের সুনাম করতেছেন, তো আমরা আমাদের খামারে বা আশেপাশে এর কোন নমুনা তো দেখি না।”
ভাই, কেমনে দেখবেন- ‘হাইব্রীড ভিগর’ আপনাকে ৫ টাকা বোনাস দিলেও ইনব্রীডিং তো আপনার ৫০ টাকা কাড়িয়া লয়। ইনব্রীডিং নামক অজাচারের দৌরাত্মে আজকে আমরা দেশের দুর্বল প্রশ্নবিদ্ধ বুলগুলোর থেকেও যতটুকু ফলাফল পাওয়ার কথা ছিল তার অর্ধেকও পাইনা।
৬২.৫% ও ‘হাইব্রীড ভিগর’:
বানিজ্যিক কারনে উদ্ভিদের ক্ষেত্রে ‘হাইব্রীড’ প্রজাতি এমনভাবে বাজারে ছাড়া হয় যেন তা থেকে বীজ তৈরি করা না যায়। কিন্তু গরুর ক্ষেত্রে এমন কোন প্রতিবন্ধকতা তৈরির সুযোগ নেই। হাইব্রীড ভিগরের উপর সবার তাই অবাধ অধিকার।
একবার চিন্তা করুন তো সর্বোচ্চ ‘হাইব্রীড ভিগর’ সমৃদ্ধ (৩৭.৫%+৬২.৫%) শাহীওয়াল-হলস্টিন ক্রসের ফ্রোজেন এমব্রায়ো বা ‘হিমায়িত ভ্রুণ’ যদি আমরা পেতাম তবে পেয়ে যেতাম অতি কাংখিত গাভী। এবার এর মধ্যে যদি অনুরূপ ‘হাইব্রীড ভিগর’ ওয়ালা (৩৭.৫%+৬২.৫%) শাহীওয়াল-হলস্টিন ক্রসের সিমেন দিয়ে খামার চালিয়ে নিয়ে যেতাম- তবে দেশে শুধু (৩৭.৫%+৬২.৫%) ক্রসজাতই থাকতো- নাম দিয়ে দিতাম “শাহীলান্ডো”।
(ব্রাজিল ঠিক এই কাজটিই গীর-হলস্টিন নিয়ে করে নাম দিয়েছে গীরোলান্ডো। এখন সারা ব্রাজিলের ৮০% দুধ উৎপন্ন হয় এই গীরোলান্ডো গাভী থেকে। বারবার ব্রাজিলের কথা আসে কারন সে দেশটা আমাদের মত বা তার চেয়েও উষ্ণ আর আর্দ্র।)
স্বপ্ন কবে সত্যি হবে?
ভাই আগে তো স্বপ্ন দেখতে শিখেন!!!
যারা হাই পার্সেন্টেজে ভাল দুধ পাচ্ছেন (অসুখ বিসুখ সত্ত্বেও) তাদের সাথে তো গলাবাজিতে পারা যায় না। অনেক খামারীর খামার হাইপার্সেন্টেজ গাভীতে ভরা। তারা সেগুলো খুব দক্ষতার সাথে পালতে চেষ্টা করেন- না পারলে নতুন খামারীর কাছে হাই দামে বেচে দেন। তো এই নতুন খামারী তখন মহা বিপদে পড়েন- আর আশেপাশের লোকজন উল্টাপাল্টা পরামর্শ দিয়ে তার জীবন বিষিয়ে তোলেন। ভাই, আজকে আপনি একটি হাই পার্সেন্টেজ গাভী তৈরি করে যদি মনে করেন ‘আমার গাভী আমার- তাতে কার কি?’ তো-এটি ভুল। আপনি যখন এটি বেচে দিবেন তখন পুরো ইন্ডাস্ট্রি ক্ষতির মুখে পড়বে। ফ্রোজেন ভ্রুণ ছাড়া একটি লো-কোয়ালিটি, ইনব্রেড, হাই-পার্সেন্টেজ গাভীর প্রজন্ম সংশোধনের কোন কার্যকরী ফর্মুলা কিন্তু নেই। অতএব, আপনার পাপে সকলের সর্বনাশ।
“এক ঘর পাপে,
চল্লিশ ঘর শাপে।”
আমরা অনেকেই বড় বড় সফল খামারীদের ঈর্ষার দৃষ্টিতে দেখি- আর নিজেকে প্রশ্ন করি—
অমুক ভাই এত ভাল গাভী পেলেন কই?
ভাই সবচেয়ে ভাল গাভী কোন দেবদূত এসে দিয়ে যায় না- ভাল গাভী ক্রসব্রিডিং এর নিয়ম মেনে, ইনব্রিডিং বাঁচিয়ে তৈরি করতে হয়। যদি এটি করতে পারেন- তবে আল্লাহর তরফ থেকে আসবে ‘হাইব্রীড ভিগর’ নামক বোনাস।
আর কোন ভাই যদি দেশীয় বা ইন্ডিয়াগামী কোন ব্যাপারীকে দেবদূত মনে করেন- তাহলে কিন্তু মরছেন। ভাল গাভী যদিওবা কপাল জোরে পান- রেকর্ড তো পাবেন না- তো সামনে আগাবেন কি করে?????
অতএব ভাই, জ্ঞানহীনতার আঁধার থেকে বেরিয়ে (৩৭.৫%+৬২.৫%) এর আলোর পথে আসুন। (যদি টিকে থাকতে চান)। দেরি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু!!!!!!
“রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?
এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে?
সেতারা, হেলার এখনো ওঠেনি জেগে?
তুমি মাস্তলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;
অসীম কুয়াশা জাগে শূন্যতা ঘেরি।”
ফেসবুক থেকে নেয়া।