Breaking News
ব্রিডিং বুল
ব্রিডিং বুল

ব্রীডিং বুল কাহিনী – অধিকার, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি”

ব্রীডিং বুল কাহিনী – অধিকার, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি”

“১ম পর্বঃ- ব্রীডিং বুল কি?”

গাভীকে ষাড় দিয়ে পাল দিলে বাচ্চা হয়। ষাড় আমাদের খামারে বা আশেপাশের খামারেই আছে।

তারপরেও আমরা এসব ষাড় দিয়ে পাল দিই না। কারন, আমরা ভাল ষাড় চাই- যাতে ভাল বাচ্চা আসে।

তো, দেশে কোথাও ভাল ষাড় থাকলে তাকে তো আর সব গাভীর কাছে নিয়ম যাওয়া সম্ভব নয়, তাই দরকার পড়ে কৃত্রিম প্রজননের।

অতএব বোঝাই যাচ্ছে- কৃত্রিম প্রজনন যেকোন পাল দেয়ার উপযোগী ষাড়ের বিকল্প নয়, বরং ভাল ষাড়ের বিকল্প।

এই ভাল ষাড়টিকেই “ব্রীডিং বুল” বলে। যেকোন প্রজননক্ষম ষাড়ই ব্রীডিং বুল নয়।

ব্রীডিং বুল সে ই যাকে দিয়ে প্রজনন করালে ভাল বাচ্চা আসবে৷

তাই ভাল ব্রীডিং বুলের সিমেন পাওয়ার অধিকার একজন ডেইরী খামারীর সর্বপ্রথম ও সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অধিকার।

এবং আমরা খামারীরা যেন সহজে, ন্যায্যমূল্যে ভাল মানের সিমেন আমাদের হাতের নাগালে পাই এটাই আমাদের একান্ত প্রত্যাশা।

কিন্তু বাস্তবে তা আমরা পাচ্ছি কি? কৃত্রিম প্রজনন খাতে যে অরাজকতা চলছে তা অন্য যেকোন অরাজক খাতকেও হার মানায়।

কৃত্রিম প্রজনন খাতের অরাজকতার চিত্রটি বুঝতে হলে প্রথমেই আমাদেরকে জানতে হবে কিভাবে বা কি কি শর্ত মেনে একটি ষাড় ব্রীডিং বুল হয়ে ওঠে। বা কিভাবে উন্নত বিশ্বে ব্রীডিং বুল তৈরি করা হয়।

১. পেডিগ্রিঃ

ব্রীডিং বুল তৈরির প্রথম শর্ত উন্নত পেডিগ্রি। ষাড়ের বাবা-মা, দাদা-দাদী, নানা-নানী ইত্যাদির ইতিহাসই ষাড়ের পেডিগ্রি।

বাবা মা ভাল হলে ষাড়টি ভাল হওয়ার একটি সম্ভাবনা থাকে৷ পেডিগ্রির লম্বা ইতিহাস থাকাটা ভাল।

কিন্তু তা যদি না থাকে তবে কমপক্ষে ষাড়ের মা (Dam) ও দাদীর (Sire’s Dam) উৎপাদনের তথ্য পাওয়া না গেলে কোন একটি ষাড় ব্রীডিং বুল হওয়ার অযোগ্য।

আবার ইনব্রীডিং ঠেকানোর জন্যও ষাড়ের পেডিগ্রি ইতিহাস জানতে হয়। অতএব কোন একটি সম্ভাব্য ব্রীডিং বুলের পেডিগ্রীর তথ্য তার প্রথম প্রকাশিত তথ্য।

২.প্রজেনী টেস্টঃ

ভাল বাবা ও ভাল মায়ের সন্তান না হলে একটি ষাড়ের ভাল হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

আবার বাবা মা ভাল হলেই যে ষাড়টি ভাল হবে তাও শতভাগ নিশ্চিত নয়৷

এজন্য দরকার হয় প্রজেনী টেস্টের। প্রজেনী মানে সন্তান বা ছেলে মেয়ে।

একটি ষাড়ের বয়স ১৮ মাস হলে তা থেকে সিমেন সংগ্রহ করে বিভিন্ন গাভীতে দেয়া হয়।

যে বকনা বাচ্চা আসল তারা যখন প্রথম বিয়ানে দুধ দিতে শুরু করে ল্যাক্টেশন শেষ করবে তখনই কেবল ষাড়ের বাচ্চা প্রথম বিয়ানে কতটুকু দুধ বাস্তবে দিল এই তথ্য পাওয়া যায়।

এভাবে ২য়,৩য়,৪র্থ প্রভৃতি বিয়ানে দুধ সংগ্রহের রেকর্ড সংরক্ষণ করা হয়।

যত বেশি হার্ডে যত বেশি সংখ্যক কন্যার রেজাল্ট পাওয়া যাবে- তার গড় বের করলে- গড়টি তত বেশি গ্রহনযোগ্য হবে।

এই যে দীর্ঘ সময় নিয়ে কন্যারা বাস্তবে কিরকম পার্ফরমেন্স দেখায় তার তথ্য নিয়ে ষাড়ের যে তথ্য পাওয়া গেল তাই ষাড়ের প্রজেনীর প্রত্যাশিত তথ্য বা EPD (Expected Progeny Difference) আর এই দীর্ঘ প্রক্রিয়াটির নাম প্রজেনী টেস্ট।

প্রজেনী টেস্ট হতে ৯৯% পর্যন্ত সঠিকভাবে ( Reliability) ষাড়ের ট্রান্সমিটিং অ্যাবিলিটি ( PTA) সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

৩. ONBS (Open Nucleus Breeding System)ঃ

প্রজেনী টেস্ট যেহেতু দীর্ঘমেয়াদী এবং কোন একটি বুল প্রজেনী টেস্টে ভাল পারফর্ম না করলে এই যে একদল অনুন্নত প্রজেনী তৈরি করা হল তা অপ্রত্যাশিত।

তাই এমন ব্যবস্থার কথা চিন্তা করা হল যেন ভাল বুল বাছাইয়ে সময় কম লাগে।

এরকম একটি পদ্ধতি ONBS (Open Nucleus Breeding System). Embryo Transfer বা ভ্রূণ প্রতিস্থাপন পদ্ধতিতে একটি ভাল গাভী ও ভাল প্রজেনী টেস্টেড ষাড় হতে অনেকগুলো ভ্রূণ তৈরি করে বিভিন্ন গাভীতে প্রতিস্থাপন করা হয় (MOET- Multiple Ovulation & Embryo Transfer)।

 

এতে অনেকগুলো বাচ্চা পাওয়া যায়। বকনাগুলো ল্যাক্টেশনে আসলে কি রকম পার্ফরম করল তা হতে ষাড় গুলোর জেনেটিক মেরিট সম্বন্ধে জানা যায়।

অর্থাৎ বোনদের পার্ফরমেন্স থেকে ভাইদের পার্ফরমেন্স সম্পর্কে ধারনা করা হয় যেহেতু বাবা মা একই (Sibling Test). এটি প্রজেনী টেস্টের মত নির্ভুল না হলেও যথেষ্ঠ গ্রহণযোগ্য।

এ পদ্ধতিতে বাছাইকৃত ব্রীডিং বুলের প্রজেনী টেস্ট চালিয়ে আরো নির্ভুল তথ্য বের করে আনা যায়৷

ONBS পদ্ধতিতে ব্রীডিং বুল বাছাইয়ে সময় প্রজেনী টেস্টের চেয়ে কম লাগে।

৪. জেনোমিক টেস্টঃ

ব্রীডিং বুল বাছাইয়ের সবচেয়ে যুগান্তকারী পদ্ধতি এটি।

একটি বুলের DNA স্যাম্পল (দেহকোষ, রক্ত বা চুল) থেকে DNA মার্কার পরীক্ষা নিরিক্ষা করে জেনমিক লাইব্রেরির সাথে তুলনা করে বুলের বিভিন্ন ট্রেইট বা বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা করা যায়।

জেনমিক টেস্ট একটি ভ্রূণ থেকে কোষ নিয়ে করা সম্ভব।

ফলে একটি বুলের জন্মের আগেই তার গুণাগুণ বলে দেয়া সম্ভব ।

তাই জেনমিক টেস্ট এখন শুধু ব্রীডিং বুল বাছাইয়েই নয় বরং কমার্শিয়াল খামারের বাছুরেরও করা হয় যাতে ভাল বাছুরগুলো রেখে খারাপগুলো কালিং(বাদ দেয়া) করা যায়।

জেনমিক টেস্ট USA, Canada, Australia, Brazil সহ ইউরোপের অনেক দেশেই করা হয়।

এটি সস্তা টেস্ট। যেকেউ চাইলে স্যাম্পল পাঠিয়ে এটি করে ফেলতে পারে৷

অতএব সারাবিশ্বে এখন যেভাবে ব্রীডিং বুল তৈরি করা হচ্ছে তা হলঃ-

ভাল পেডিগ্রি দেখে বাবা মা সিলেক্ট করা হয়। ষাড় বাচ্চা হলে তার জেনমিক টেস্ট করে ব্রীডিং মেরিট দেখা হয়।

ব্রীডিং মেরিট ভাল হলে “জেনমিক বুল” হিসেবে সিমেন সংগ্রহ ও বিক্রি শুরু হয়।

সেই সাথে চলতে থাকে প্রজেনী টেস্ট। প্রজেনী টেস্টের রেজাল্ট আসতে শুরু করলে তা হয়ে যায় “ডটার প্রুভেন বুল”।

এতক্ষণ যা বললাম তা নির্দিষ্ট পিওর ব্রীডের জন্য (যেমন হলস্টিন, জার্সি, গীরের) জন্য ঠিক আছে।

কিন্তু গরমের দেশের জন্য জেবুর সাথে টরাইন গরু ক্রস করে ক্রসব্রীড বুল তৈরির জন্য সঠিক ক্রসব্রীডিং জরুরী।

৫. ক্রসব্রীডিং:

ক্রসব্রিডিং হল দুই বা ততোধিক পিওর ব্রীডের মিশ্রণ ঘটানো।

ক্রসব্রিডিং এর উদ্দেশ্যই হল ভাল ভাল গুণাবলির সমন্বয় ঘটানো৷ ক্রস ব্রীডিং অনেক বড় চ্যাপ্টার।

ক্রসব্রিডিং এর ক্ষেত্রে আপাতত দুটি জিনিস বুঝলেই চলবেঃ-

একঃ

একটি পিওর ব্রীডের সাথে আরেকটি পিওর ব্রীডের ক্রসেই সবচেয়ে ভাল রেজাল্ট আসে।

দুইঃ

যদি একটি ক্রসব্রীড বা কম্পোজিট ব্রীডের সাথে নতুন একটি ব্রীডের ক্রস করা হয় তবে বাচ্চারা মায়ের গুণাগুণ বেশি পায়।

( As more breeds contribute to the composite, retained individual and maternal heterosis increases)

সহজে বললে – একটি পিওর ব্রীডের ভাল গাভীর সাথে অন্য আরেকটি পিওর ব্রীড ষাড়ের প্রজনন করলেই কেবল ভাল একটি ক্রসব্রীড বাচ্চা তৈরি হবে।

উদাহরণ দিচ্ছি- পিওর ব্রীড ভাল দুধের জেবু হল ব্রাজিলিয়ান গির ও ভারতীয় শাহীওয়াল এবং পিওর ব্রীড ভাল দুধের টরাইন হল হলস্টিন ও জার্সি।

তাহলে ভাল পেডিগ্রি দেখে একটি পিওর গীর বা শাহীওয়াল গাভীতে ভাল মানের পিওর হলস্টিন বা জার্সি দিলে যে বাচ্চাটি আসবে তা ভাল মানের ক্রসব্রীড হবে।

অপরদিকে আমাদের দেশী গরু পিওরব্রীড নয়- এটি ৮-২৭ টি ভারতীয় ইন্ডিজেনাস জাতের মিশ্রণ।

এটি নিজেই ক্রসব্রীড (বা হয়তো কম্পোজিট ব্রীড)। তাই দেশী গাভীর সাথে হলস্টিন বা জার্সির ক্রস করালে যে ক্রসব্রীড তৈরি হবে তাতে দেশীয় গাভীর গুণাগুণ প্রাধান্য পাবে৷ ( Maternal Heterosis). অর্থাৎ দেশী গাভীর দুধ কম, তাই ক্রসটির দুধ আশানুরূপ হবে না৷

পেডিগ্রী, প্রজেনী টেস্ট বা জেনমিক টেস্ট হতে ষাড়ের কেবল দুধ উৎপাদনের তথ্যই বের করা বা প্রকাশ করা হয় তা নয় বরং অনেকগুলো তথ্য প্রকাশিত হয়।

যেমনঃ-

১. দুধ উৎপাদনঃ এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। একটি ষাড় দুধে ভাল না হলে তার অন্যান্য গুণ থাকলেও ডেইরি ইন্ডাস্ট্রিতে তা মূল্যহীন।

২. ফ্যাট ও প্রোটিন পার্সেন্টেজঃ এটি যত বেশি হবে তত ভাল।

৩. সোমাটিক সেল স্কোরঃ এটি যত কম হবে দুধে দেহকোষের পরিমান তত কম হবে। ফলে ম্যাস্টাইটিস এর প্রবণতা কমবে।

৪. ফিড এফিশিয়েন্সিঃ এই স্কোরটি যত ভাল হবে তত খাদ্য কম লাগবে।

৫. কাভিং ইজঃ এই স্কোর যত কম বাচ্চা প্রসব তত জটিলতাহীন।

৬. আডার কম্পোজিটঃ এই স্কোর যত ভাল ওলান তত সুগঠিত।

৭. ফিট এন্ড লেগ কম্পোজিটঃ এই স্কোর যত ভাল পা তত শক্তিশালী ও সুগঠিত হবে।

৮. প্রোডাক্টিভ লাইফঃ এই স্কোর ভাল হলে কন্যারা বেশি দিন উৎপাদনক্ষম থাকবে।

ইত্যাদি।

এতক্ষণ আমরা জানলাম ব্রীডিং বুল কিভাবে তৈরী হয়।


post credit Khalid H Sarker Robin

Please follow and like us:

About admin

Check Also

ডেইরি_ব্রীড_টেস্টিং_রিসার্চ_প্রজেক্ট

#ডেইরি_ব্রীড_টেস্টিং_রিসার্চ_প্রজেক্ট দেশে ডেইরি শিল্পের উন্নয়নের লক্ষ্যকে সামনে রেখে ডেইরি ব্রীড টেস্টিং রিসার্চ প্রজেক্টের মাঠ পর্যায়ের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Translate »