Breaking News
জেনেটিক্স
জেনেটিক্স

ডেইরি_জেনেটিক্সঃ ৩

#ডেইরি_জেনেটিক্সঃ

আজকের লেখায় খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় নিয়ে লিখবো। বিষয়টা হচ্ছে গাভীর প্রজননতন্ত্র এবং প্রজননতন্ত্রের হরমোন। লেখাটি খুব বড় বিধায় দুই পার্টে লিখবো। আজকের টপিকসটি খামারী বা কৃত্রিম প্রজনন কর্মী বা যারা ভবিষ্যতে নিজে নিজেই কৃত্রিম প্রজনন করতে চায় তাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারন গাভীর প্রজননতন্ত্র বিষয়ে স্বচ্ছ ধারনা না থাকলে কৃত্রিম প্রজননে সফলতা অর্জন করা যাবেনা। । এই আলোচনার সময় সংশ্লিষ্ট কিছু বিষয় চলে আসব যা নিয়ে অল্প কথায় ব্যাখা দেবো।

গাভী এবং ষাঁড়ের প্রজনন তন্ত্র নিয়ে অনেক এ আই টেকনিশিয়ানদেরও স্পষ্ট ধারনা নেই। বরিশাল জেলা কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রে আমি প্রায় সাড়ে তিন বছর সায়েন্টিফিক অফিসার হিসেবে ছিলাম। সরকারী বেসরকারি বেশ কয়েকজন কৃত্রিম প্রজনন কর্মীদের সাথে অনেকবার কথা হয়েছে, মেলামেশার সুযোগ হয়েছে। দূর্ভাগ্যের বিষয় অনেক কর্মীদের প্রজননতন্ত্র সম্পর্কে ধারনা শুধু জরায়ু আর সার্ভিক্স এর মাঝে সীমাবদ্ধ। খুবই অস্পষ্ট ধারনা নিয়ে তারা খামারীদের গাভীতে প্রজনন করায়! এমনকি স্বেচ্চাসেবী টেকনিশিয়ানদের ক্লাস নেয়ার সময়ও প্রজননতন্ত্রের খুটিনাটি শেখার চেয়ে চিকিৎসা শিখতে আগ্রহ বেশি দেখা যায়।

যাই হোক মূল আলোচনা শুরু করা যাক।

গাভীর প্রজনন তন্ত্র বা রিপ্রোডাকটিভ সিস্টেমকে ৬ টি ভাগে ভাগ করা যায়

১)ডিম্বাশয় বা ওভারি
২) ডিম্বনালী বা ফ্যালোপিয়ান টিউবস বা ওভিডাক্ট
৩) জরায়ু বা ইউটেরাস
৪) জরায়ু মুখ বা সার্ভিক্স
৫) যোনী বা ভ্যাজাইনা
৬) যোনীদ্বার বা ভালভা

এই পার্টগুলোর কাজ এবং কি কি হরমোন নিঃসৃত হয় এবং তাদের কাজ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করব। যদিও আমার লেখায় ডিটেইলস বেশি চলে আসে। অল্প কথায় বুঝাতে না পারা ব্যর্থতার জন্য আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

১) ডিম্বাশয় বা ওভারীঃ

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রজনন অঙ্গ। গাভীতে এক জোড়া ডিম্বাশয় থাকে। ডিম্বাশয়ের প্রধান কাজ হচ্ছে ডিম্বানু বা ওভাম তৈরি করা এবং গুরুত্বপূর্ণ হরমোন নিঃসৃত করা। ডিম্বাশয় থেকে নিচের হরমোনগুলি নিঃসৃত হয়ঃ

ক) #ইস্ট্রোজেনঃ

প্রজননের সহায়তাকারী প্রধান হরমোন। এই হরমোন নিঃসৃত হলেই বুঝা যায় গাভী সাবালিকা (!)/প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছে। এই হরমোনের বৃদ্ধির ফলে ওভারিয়ান ফলিকলগুলো পরিপক্ক ( Mature) হয়ে ডিম্বানুতে (Ovum) এ পরিণত হয়। এই ডিম্বানু যখন ফ্যালোপিয়ান টিউবে পড়ে তখন তাকে বলা হয় ওভুলেশন। ওভুলেশনের পর ইস্ট্রোজেন লেভেল আবার কমে যায়। অর্থাৎ এই হরমোনেরর কারনেই গাভী হীটে আসে, সার্ভিক্স বা জরায়ুমুখে মিউকাস নিঃসরণ হয় ফলে সিমেন পরিবহনে সুবিধা হয়, তাছাড়া জরায়ু সেন্সিটিভভ হয়ে ফার্টিলাইজেনশনের উপযোগী হয়। এমনকি এই হরমোনের কারনে গাভীর ওজন এবং দৈহিক বৃদ্ধিও বাড়ে।

এই ইস্ট্রোজেন হরমোন জন্মনিয়ন্ত্রন কাজে ব্যবহৃত হয়। ইমার্জেন্সী কন্ট্রাসেপটিপ পিলে এই ইস্ট্রোজেন ব্যবহৃত হয়। আমাদের দেশে লজ্জাবতী নামে যে ঘাস দেখা যায় সেটাতে এই হরমোন থাকে। কোন প্রেগন্যান্ট গাভী এই ঘাসটা খেলে তার অকাল গর্ভপাত ঘটতে পারে।

প্রশ্নঃ তাহলে গাভী হিটে না আসলেই কি বুঝে নেব এই হরমোন দায়ী?

উত্তরঃ প্রতিটি গাভী প্রাপ্তবয়স্ক হলেই হিটে আসে। হিটে না আসলে শুধু হরমোনকে দ্বায়ী করা যাবে না। হিটে আসার জন্য কয়েকটা বিষয় খেয়াল রাখা দরকারঃ

প্রথমত, গাভীর বয়স। এইখানে জেনেটিক্স এর ব্যাপার আছে। পিউর ফ্রিজিয়ান প্রথম হিটে আসে ১২ মাসে, পিউর শাহীওয়াল হিটে আসে ২৪ মাসে, আর দেশি হিটে আসে ২৪-৩৬ মাসে। আবার ফ্রিজিয়ান ক্রস দেশি গাভী প্রথম হিটে আসে ১৪ থেকে ১৮ মাসে। এমনকি ১২ মাসেও হিটে আসতে দেখছি আমি । আবার ফ্রিজিয়ান ক্রস শাহীওয়াল গাভী প্রথম হিটে আসে ২৪ মাসে। শাহীওয়াল দেশীও ২৪ মাস বা তার চেয়ে বেশী সময় লাগে। এইখানে শাহীওয়ালের জিনটা ডমিন্যান্ট তাই পিউর শাহীওয়ালের মতই দেরিতে হিটে আসে গাভী। সুতরাং খামারীকে এসব ক্রসব্রিডের প্রথম হীটে আসার সঠিক সময় সম্পর্কে স্পষ্ট ধারনা থাকতে হবে।

দ্বিতীয়ত, গাভীর প্রজননতন্ত্রে যদি ঠিকমত ম্যাচুইরিটি না আসে বা অপুষ্টির অভাবে ঠিকমত বাড়তে না পারে তাহলেও গাভী দেরিতে হিটে আসতে পারে। কারন প্রজননতন্ত্র সঠিক বৃদ্ধি না হলে এটা কাজ শুরু করবেনা। তাই খামারীদের উচিত গাভীর জাত দেখে তার হীটে আসার কয়েকমাস আগে থেকেই পুষ্টিকর খাবার এবং ভিটামিন সরবরাহ করা।

তৃতীয়ত, গাভীর প্রজনন তন্ত্রে কোন রোগ বা অস্বাভাবিকতা থাকলেও গাভী হিটে আসবে না।

এবং চতুর্থত, উপরের সব কিছু যদি ঠিক থাকে তাহলে বুঝতে হবে গাভীর ডিম্বাশয় থেকে প্রয়োজনীয় হরমোন নিঃসৃত হচ্ছে না। ফলে গাভী হিটে আসছে না।

খামারীদের এই বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে। হীটে না আসলে অনেকেই ভেট বা এআই কর্মী ডেকে একগাদা এন্টিবায়োটিক, ভিটামিন, হরমোন ইঞ্জেকশন দিয়ে দেয়। অথচ একটু সচেতন থাকলে এইগুলো সহজেই এড়ানো যায়।

প্রশ্নঃ গাভী প্রথমবার হিটে আসলেই কি আমরা প্রজনন করাবো?

উত্তরঃ না! আমাদের উচিত একটা বা দুইটা হিট মিস দিয়ে ৩য় হিটে প্রজনন করা। কারন প্রজনন তন্ত্রের পরিপক্ক বা ম্যচুইরিটি বলে একটা কথা আছে। যেমন, ফল পাকার উদাহরনটাই দেই। একটা ফল তো একেবারেই পরিপক্ক হয়ে যায় না, অল্প অল্প করে পেকে অতঃপর পূর্ণাংগ পরিপক্ক হয়। তেমনি প্রথম হিটে আসাই মানে এটি প্রজননের জন্য প্রস্তুত বলা যায়না। ফুল ফাংশনাল প্রজননতন্ত্রের জন্য একে আরেকটু সময় দিতে হয়। কারন প্রথম হীটেই যদি প্রজনন করা হয় এবং এতে সমস্যা দেখা দেয় তাহলে ভবিষ্যতে প্রজননেও আরো বেশী সমস্যা দেখা দিবে।

খ) #প্রোজেস্টেরনঃ
আরেকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ হরমোন। একে প্রেগন্যান্সি হরমোন বলা হয়। গাভীর প্রেগন্যান্সির ২৭০ দিন এই হরমোনটা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে থাকে। যেমন,
– জরায়ুর লাইনিং তৈরি করে যাতে ভ্রূনটা ঠিকমত প্রতিস্থাপিত হতে পারে।
– ম্যামারি গ্লান্ড বা দুগ্ধ গ্রন্থি ডেভেলপ করে
– গাভীর হিটে আসা বন্ধ করে,
– জরায়ুর নড়াচাড়া বন্ধ করে ।

এই হরমোন তৈরি হয় ওভারির করপাস লুটিয়ামে। ডিম্বানু যখন ওভারি থেকে বের হয়ে ফ্যালোপিয়ান টিউবে পড়ে তখন সেই ডিম্বানুর খোসাকে বলা হয় করপাস লুটিয়াম (Corpus Luteum) । ওভুলেশন বা ডিম্বক্ষরণের পরে ডিম্বানুটা যদি্ স্পার্ম দ্বারা নিষিক্ত বা ফার্টিলাইজড হয় তাহলে করপাস লুটিয়াম থেকে প্রোজেস্টেরন হরমোন তৈরি হয় । আর যদি ওভাম নিষিক্ত না হয় তবে ইস্ট্রোজেন হরমোন করপাস লুটিয়ামকে ধ্বংস করে ফেলে।ফলে গাভী পুনরায় হিটে আসে।

গ)#রিলাক্সিনঃ

নাম শুনেই বুঝতে পারছেন, এটা রিলাক্স বা শিথিল করে। এটা বাচ্চা জন্মের সময় সার্ভিক্স আর ভ্যাজাইনাকে প্রসারিত (ডায়ালেট) বাচ্চা বেরোতে সাহায্য করে। গর্ভাবস্থায় যদি জরায়ুর কন্ট্রাকশন বেড়ে এবরশন হওয়া শুরু হয় তখন রিলাক্সিন হরমোন দিয়ে কন্ট্রাকশন বন্ধ করা হয়।

ঘ) #অক্সিটোসিনঃ
রিলাক্সিন হরমোনের বিপরীত কাজ করে এটি। এটি মস্তিস্কের হাইপোথ্যালামাস এবং ওভারি, দুই জায়গাতেই তৈরি হয়। অক্সিটোসিন জরায়ুর কন্ট্রাকশন (সংকোচন) বাড়িয়ে স্পার্মকে ফ্যালোপিয়ান টিউবে যেতে সাহায্য করে থাকে এবং বাচ্চা প্রসবে সহায়তা করে। এমনকি বাচ্চা প্রসব হবার পরে যদি গর্ভফুল (প্লাসেন্টা) না পড়ে তাহলে এই অক্সিটোসিন হরমোন ইঞ্জেকশন দিয়ে কন্ট্রাকশন বাড়িয়ে প্লাসেন্টা বের করা হয়। গাভীর দুধ দোহনেও এই হরমোনের ভুমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

এই হরমোনগুলো ছাড়াও FSH হরমোন ওভারিয়ান ফলিকলের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে এবং LH হরমোন ডিম্বানু রিলিজ করে ওভুলেশনে সহায়তা করে।

২) ডিম্বনালী বা ফ্যালোপিয়ান টিউবস:
এটা একটা লম্বা নালী যেখানে ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বানু পতিত হয় এবং শুক্রানু দ্বারা ডিম্বানু নিষিক্ত হয়। ফ্যালোপিয়ান টিউববের কয়েকটা পার্ট আছে যেমন, ফানেল এর মত দেখতে ইনফান্ডিবুলাম যা ওভারি থেকে ডিম্বানু গ্রহন করে, এম্পুলা এবং ইসথমাস (Isthmus) । ইসথমাস এর পরের পার্ট হচ্ছে জরায়ু। জরায়ু এবং ইসথমাসের সংযোগস্থলকে Utero-tubal Junction (UTJ) বা ইউটেরো টিউবাল জাংশন বলে। গাভী হিটে আসলে যে সীমেন দেয়া হয় তা এই জাংশনে এসে অপেক্ষা করে ডিম্বানুর জন্য। ডিম্বানু ক্ষরন হলে তা ইনফান্ডিবুলাম হয়ে এম্পুলাতে আসে, শুক্রানুগুলোও এম্পুলাতে যায় এবং ডিম্বানুর সাথে নিষিক্ত হয়ে জাইগোটে পরিণত হয়। অর্থাৎ এম্পুলাই হচ্ছে সাইট অফ ফার্টিলাইজেশন। ৩ থেকে ৪ দিনের মাঝে এই জাইগোট জরায়ুতে চলে আসে। ১০-১২ দিনের মাঝে জাইগোট ভ্রুন বা এমব্রায়োতে পরিণত হয় এবং জরায়ুর হর্ণ অফ দ্যা ইউটেরাসের অস্থায়ীভাবে প্রতিস্থাপিত হয়।

 

এ এফ এম ফয়জুল ইসলাম
এম এস ইন এনিম্যাল ব্রিডিং এন্ড জেনেটিক্স
বিএস সি ইন এনিম্যাল হাজবেন্ড্রি ।

Please follow and like us:

About admin

Check Also

ডেইরি_ব্রীড_টেস্টিং_রিসার্চ_প্রজেক্ট

#ডেইরি_ব্রীড_টেস্টিং_রিসার্চ_প্রজেক্ট দেশে ডেইরি শিল্পের উন্নয়নের লক্ষ্যকে সামনে রেখে ডেইরি ব্রীড টেস্টিং রিসার্চ প্রজেক্টের মাঠ পর্যায়ের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Translate »