খাসী মোটাতাজাকরণ-
আমাদের দেশে ছাগল পালনের লক্ষ্য কিন্তু শেষ পর্যন্ত মাংস উৎপাদন। তাই খাসী মোটাতাজাকরণ প্রকল্প হতে পারে আপনার জন্য একটি লাভজনক প্রকল্প। বিশেষ করে যারা নতুন খামারি তারা ব্রিডিংয়ে যাওয়ার আগে খাসী মোটাতাজাকরণ প্রকল্প শুরু করতে পারেন। খাসী মোটাতাজাকরণ একদিকে যেমন ভালো লাভজনক, অন্যদিকে খাসী মোটাতাজাকরণের মাধ্যমে আপনি ছাগল পালন সম্পর্কিত প্রাথমিক অভিজ্ঞতা অর্জন করে নিতে পারেন। আমি নিজে শখের বশে খাসী মোটাতাজাকরণ নিয়ে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছি খাসী মোটাতাজাকরণ অনেক লাভজনক একটি প্রকল্প। সঠিকভাবে খাসী মোটাতাজাকরণ করতে পারলে অসাধারণ ফলাফল পাওয়া যায় এবং আপনি খুব দ্রুত ব্যবসায়িক সাফল্য অর্জন করতে পারবেন। আজ আমি খাসী মোটাতাজাকরণ সম্পর্কিত আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা আপনাদের সাথে শেয়ার করছি………
===== খাসী মোটাতাজাকরণ প্রকল্পের সুবিধাবলী:
১. ঝামেলা কম, খরচও তূলনামূলকভাবে কম।
২. অনেক কম পুঁজিতে খাসী মোটাতাজাকরণ প্রকল্প শুরু করা যায়
৩. খাসী যেকোনো সময় বিক্রি করে দেওয়া যায়, খাসী বিক্রির জন্য কোনো চিন্তা করার দরকার পড়েনা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো- অনলাইনে নিজের জিনিস বিক্রি করতে গিয়ে দালাল তকমা পাওয়া লাগেনা…..!!!!
৪. খাসী কিনে ঠকার ভয় থাকেনা, সামান্য ঠকলেও অল্প কিছুদিন খাওয়ালেই তা পুষিয়ে নেওয়া যায়
৫. খাসী মারা যাওয়া ছাড়া মূলধন হারানোর ভয় থাকেনা।
৬. আপনার কাছে ভালোমানের খাসী আছে জানলে এলাকায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আপনার খাসী অগ্রাধিকার পাবে, আপনাকে বিক্রি করার জন্য কারো দ্বারস্থ হওয়া লাগবেনা এবং ভালো দাম পাবেন…..
৭. খাসী সংগ্রহ করা খুবই সহজ, একটু কষ্ট করলেই সস্তায় ভালোমানের খাসী সংগ্রহ করা যায়।
===== খাসী মোটাতাজাকরণের ধাপসমূহ:
===== ভালোমানের খাসী সংগ্রহ করা:
ভালোমানের খাসী সংগ্রহ করা গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘ্যমেয়াদে ভালোজাতের/ক্রস জাতের লম্বা-চওড়া খাসী ভালো, স্বল্প মেয়াদে দেশী খাসী ভালো। তবে একটু ভালো গ্রোথ ও ভালো গঠন দেখে কিনতে হবে। পিছনের পায়ে মাংস থাকতে হবে, চামড়া ঢিলা থাকতে হবে। ৮/৯ মাস বয়সী বা সদ্য দাঁত হওয়া খাসী মোটাতাজাকরণের জন্য খুব ভালো হয়। কোনোভাবেই স্বাস্থ্যবান খাসী কেনা যাবেনা। তাহলে আপনার ব্যবসা হওয়ার আগেই হয়ে যাবে….!!!! আরেকটা কথা, যতটা সম্ভব শুকনো, হাড় জিরজিরে খাসী কিনবেন, তাহলে কম দামে পাবেন, লাভের অঙ্কটাও তরতর করে বেড়ে যাবে…….!!!!
===== কৃমিমূক্তকরণ:
যেকোনো প্রাণীর ক্ষেত্রে এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ, এখানে সামান্যতম ত্রুটিও আপনার পুরো প্রজেক্ট ভেস্তে দিতে পারে। দেখা গেলো আপনি খাওয়াবেন আপনার খাসীকে, মোটাতাজা হবে কৃমি……….!!!!!
===== কৃমিমূক্ত করার ক্ষেত্রে আমার কৌশল:
আমি প্রথমে একটা একটা খাসীকে খামারে এনে ৮/১০ দিন একেবারে যৎসামান্য খাবার দেই, কোনোমতে বেঁচে থাকার মত। তাতে লাভ দুইটা, ডিওয়ার্মিং হয়ে যায়, ছাগলের শরীরে বসবাসকারী কৃমির মত পরজীবীগুলোও দূর্বল হয়ে যায়। এবার কৃমির ঔষধ দিলে খুব ভালো ফল পাওয়া যায়। কৃমির ঔষধ হিসেবে প্রথমে এ-মেক্টিন প্লাস চামড়ার নিচে দিতে হবে। তার চৌদ্দ দিন পর নাইট্রোনিক্স ইঞ্জেকশান দিতে হবে চামড়ার নিচে। আরো অনেক মুখে খাবার ঔষধ এবং ইঞ্জেকশান আছে, যেটাই দেন না কেনো ছাগলগুলো যেনো নিশ্চিতভাবেই কৃমি মূক্ত হয়। দুইটা ইঞ্জেকশানই দেওয়ার পর খাসীকে ৪/৫ দিন লিভার টনিক খাওয়াবেন। ১৫ দিন পর মূল শেডে তোলার আগে পি.পি.আর টিকাটা দিয়ে নেবেন। উকুন জাতীয় পরজীবীর ক্ষেত্রে ভারমিন ইঞ্জেকশান ভালো কাজ করে।
===== খাবার:
খাসীগুলো এখন আপনার মূল প্রজেক্টে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। এই পর্যায়ে আপনার কাজ শুধুই পর্যাপ্ত প্রোটিন ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার সরবরাহ করা। সঠিক মাত্রায় সঠিক খাবারই হবে আপনার ব্যবসার সিক্রেট। তাহলে খাবার মেনুটা দেখে নেওয়া যাক।
মোটাতাজাকরণের খাসীকে স্বাভাবিক অন্যান্য ছাগলের মতই খাবার দিতে হবে . নিম্নোক্ত উপাদানগুলো বেশী পরিমাণে দিতে হবে।
১. ভুট্টা ভাঙ্গা (শুকনো অবস্থায়, ১২/২৪ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে বা সিদ্ধ করে দিতে পারেন। প্রশ্ন হলো কতটা দিবেন…?? খাসী যতটা হজম করতে পারে, অর্থাৎ পায়খানা সামান্য নরম না হওয়া পর্যন্ত অল্প অল্প করে পরিমাণ বাড়াতে থাকবেন, যখন দেখবেন পায়খানা সামান্য নরম নরম ভাব তখন আর পরিমাণ বাড়াবেন না, বরং সামান্য কমিয়ে সহনীয় করে দিবেন। ভুট্টা ভাঙ্গা মোটাতাজাকরণে দুর্দান্ত কাজ করে…!!!
২. অঙ্কুরিত ছোলা। অঙ্কুরিত ছোলা খাসীর মাংসপেশি বৃদ্ধিতে দারুণ কাজ করে…!!!! (এটা একটু ব্যয়বহুল মনে হতে পারে,
৩. গম (আস্ত বা ভাঙ্গা, তবে পাউডারটা না দেওয়াই ভালো। গমও আপনি সরাসরি অথবা এক বেলা ভিজিয়ে রেখে তারপর দিতে পারেন)
৪. চিটাগুড়। চিটাগুড় মোটাতাজাকরণের প্রাণীকে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাওয়ানো উচিৎ।
৫. বেশী পরিমাণে সবায়িন খৈল বা সূর্যমূখীর খৈল (দিনে ২০০ গ্রাম হারে দিতে পারেন)।
৫. নিয়মিত ভালো কোনো ভিটামিন-প্রিমিক্স এবং ক্যালসিয়াম খাওয়াতে হবে।
৬. সস্তায় পাওয়া গেলে আলু বা মিষ্টি কুমড়া ছোটছোট করে কেটে কাঁচা অবস্থায় খাওয়াতে পারেন।
৮. বিক্রির ১৫/২০ দিন আগে দ্রুত চর্বি বাধানোর জন্য এবং চেহারা চকচকা-ফকফকা-তেলতেলা করার জন্য সামান্য পরিমাণে সরিষা (আস্ত) খাওয়াতে পারেন……!!!
এইসবগুলো খাবারই আস্তে আস্তে পরিমাণ বাড়াতে হবে। একবারে হুট করে এসব খাবার বেশী দিয়ে ফেললে যদি পাতলা পায়খানা শুরু হয়ে যায় তাহলে আপনি নিশ্চিতভাবেই অন্তত কয়েকদিনের জন্য পিছিয়ে পড়বেন….!!!!
***** অনেক ভাই জাউ রান্না করে খাওয়ান এবং তাতে ভালো ফলাফল পেয়েছেন। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে কোনো রুমেন্টাল বা জাবর কাটা প্রাণীকে সিদ্ধ করা খাবার খাওয়ানোর পক্ষপাতী না। যেকোনো খাবার সিদ্ধ করার পর তার গুনাগুণ সামান্য পরিমাণে হলেও নষ্ট হয় বলে আমার বিশ্বাস।
***** আরেকটা কথা, ছাগলকে ইউএমএস বা ফার্মেন্টেড কর্ন খাইয়েও স্বল্প খরচে মোটাতাজা করা যায়, এটি বিজ্ঞানসম্মতও বটে। কিন্তু কেনো জানিনা, এই ব্যাপারটা আমি মন থেকে পছন্দ করতে পারিনা।
===== কেমন লাভ হতে পারে:
সর্ব প্রথম বলে নেই, লাভ লস সম্পূর্ণ তকদীর তথা ভাগ্যের ব্যাপার। তবে আমি যেমনটা বাস্তবে দেখলাম তার একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছি।
– ভালো জাতের ছাগলের ক্ষেত্রে দিনে যদি ২০০ গ্রাম+ ওজন বাড়ে তাহলে মাসে ৬ কেজি+ ওজন পাওয়া যাবে। যেখান থেকে মোটামুটি চার কেজির মত মাংস পাওয়া যাবে, যার বাজারমূল্য ৭০০ টাকা হিসেবে মাসে ২৮০০ টাকা। ধরলাম গড়ে দেশী ও ভালোজাত মিলিয়ে মাসে সাড়ে তিন/তিন কেজি মাংস বৃদ্ধি পেলো। তাহলে তার বাজারমূল্য দাঁড়াবে ২১০০/২৪০০ টাকা। আরো যদি কম করে ধরি তাহলে কোনো অবস্থাতেই সেটা আল্লাহর রহমতে ২০০০ টাকার নিচে না। একটা খাসীর মাসিক খাবার খরচ গড়ে ৬০০ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৮০০/৯০০ টাকার মধ্যে থাকবে। তাহলে একটা খাসী থেকে মাসে মোটামুটি হলে ১২০০-২০০০ টাকা লাভ থাকছে। যদি তিন মাস পালন করেন তাহলে একটা খাসী থেকে ৩.৫/৪/৫ হাজার টাকা অনায়াসে লাভ করতে পারবেন। সেইসাথে আপনি কেনার সময় এক-দেড় হাজার টাকা লাভ করবেন। তাহলে সব মিলিয়ে দেখা যায় খাসী মোটাতাজাকরণে লাভ আল্লাহর রহমতে খারাপ হয়না। লাভ-লসের ক্ষেত্রে নিয়ত সহীহ রাখুন এবং আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন। মনে রাখবেন, আল্লাহ পাক যদি বরকত দান করেন তাহলে অনেক সামান্য কিছু থেকেই বিশাল কিছু অর্জন করা সম্ভব।
===== সতর্কতা:
১. খাসী কেনার উপর আপনার লাভ অনেকাংশে নির্ভর করে, তাই দেখেশুনে খাসী কিনুন। প্রয়োজন হলে অভিজ্ঞ লোকের সাহায্য নিন। সবচেয়ে ভালো হয় বিভিন্ন এলাকায়, বাড়ি বাড়ি ঘুরে খাসী কেনা। হাট থেকে কিনতে পারেন, কিন্তু হাটে অনেক ক্রেতা থাকায় যেকোনো জিনিসের দাম বেশ কম্পিটিটিভ থাকে। তবে আপনি যে খাসীগুলো কিনবেন সেগুলো শুকনো এবং হাড় জিরজিরে হওয়ায় ক্রেতা কম থাকবে। হাটের ছাগলের ক্ষেত্রে পি.পি.আর থেকে সাবধান……!!!!
২. খাসীর পরিপূর্ণ স্বাস্থ্য হয়ে গেলে সাথে সাথেই বিক্রি করে দিন। একবার স্বাস্থ্য পরিপূর্ণ হয়ে গেলে তাকে খাইয়ে শুধু চর্বি বৃদ্ধি ছাড়া আর কোনো লাভ হবেনা।
৩. কখনোই কেনার সময় খাসীর চেহারা দেখে কিনবেন না, শুধুমাত্র গায়ে কতটুকু মাংস আছে সেই হিসেবে কিনবেন। মনে রাখবেন, যেকোনো খাসী ভালোভাবে যত্ন নিলে এবং স্বাস্থ্য ভালো হয়ে গেলে চেহারা আল্লাহর রহমতে অটোমেটিক ভালো হয়ে যাবে। খামখা টাকা দিয়ে চেহারা কেনার দরকার নেই……..!!!!
৪. নিয়মিত প্রতিটি খাসীর বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করুন। সম্ভব হলে ১৫ দিন অন্তর প্রতিটি খাসীর ওজন নিন এবং নোট রাখুন। কাজটা কঠিন মনে হলেও ওজন নেওয়ার পর যখন দেখবেন আপনার খাসীগুলো দারুণ বৃদ্ধি পাচ্ছে তখন ওজন নেওয়াটা আর কষ্টকর মনে হবেনা……!!!
৫. কিছু কিছু খাসী চিররুগ্ন বা রোগা থাকে, যাদেরকে যা কিছুই খাওয়ান না কেনো স্বাস্থ্য ভালো হবেনা। যদি দূর্ভাগ্যক্রমে আপনার ভাগ্যে এমন কোনো খাসী মিলে যায় তাহলে তাকে দ্রুত কসাইখানায় পাঠান….!!!
৬. সবসময় ৫-৬ হাজার টাকার মধ্যে খাসী কেনার চেষ্টা করবেন…
===== অন্যান্য পরিচর্যা:
মোটাতাজাকরণের খাসীকে পর্যাপ্ত ব্যায়াম করার/খেলাধুলা করার সুযোগ দিন। সম্ভব হলে প্রতিদিন বা একদিন অন্তর একদিন সারা শরীর ব্রাশ করে দিন। তাতে রক্ত চলাচল বৃদ্ধি পাবে এবং খাসীগুলো চনমনে থাকবে, ভালো বৃদ্ধি ঘটবে। সপ্তাহে একদিন সম্ভব হলে শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করান। এবং গোসল করানোর পর অবশ্যই ব্রাশ দিয়ে সারা গায়ের পশম আঁচড়ে দেবেন। তাহলে খাসীগুলো সবসময় ফিটফাট ফুলবাবু হয়ে থাকবে এবং দেখতে আকর্ষনীয় হবে। ফলে যেকোনো সময় ফার্মে কোনো খরিদ্দার আসলে সে সহজেই আপনার খাসীর প্রেমে পড়ে যাবে……!!! মনে রাখবেন, ক্রেতার প্রেম মানেই আপনার পকেট গরম……!!!
পুনশ্চ: নিজের ভয়ানক ব্যস্ততার মধ্যেও কষ্ট করে সময় বের করে খামারী ভাইদের জন্য এত কথা লিখলাম। এই লেখার মধ্যে যা কিছু আছে পুরোটাই আমার বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে লিখেছি। তাই ভুল হওয়া অস্বাভাবিক কিছুনা। যদি কোনো ভুল লিখে থাকি দয়া করে শুধরে দেবেন। আমি নিজেও শিখছি। আমার এই পরিশ্রম থেকে কোনো খামারী ভাই যদি সামান্যতমও উপকৃত হন তাহলেই আমার কষ্ট সার্থক হবে।
আধুনিক পদ্ধতিতে পশু পালন ও পরামর্শ কেন্দ্র নামক গ্রোপ থেকে নেয়া