ক্রসব্রিড ক্যাটল বা সংকর জাতের গরু এবং গরুর দেশীয় জাত সংরক্ষণ নিয়ে কিছু আলোচনা।
—————————————————-
গত এক দশকে বাংলাদেশে গরুর সংকরীকরণ হয়েছে অনেক। দেশে গরুর সংকরীকরণ কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৫৮ সালে।
সে সময় পশুসম্পদ অধিদপ্তরের আর্টিফিশিয়াল ইনসেমিনেশন (এআই বা কৃত্রিম প্রজনন) কার্যক্রমের মাধ্যমে শুরু হয় গরুর সংকরীকরণ।
১৯৭৫-৭৬-এর দিকে এসে এ কার্যক্রম আরো জোরালো হয়ে ওঠে। ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সাভার ডেইরি ফার্ম।
সে সময় এখানে সিন্ধি, শাহিওয়াল ও থরপারকার জাতের গরুর সঙ্গে স্থানীয় গরুর সংকরীকরণ শুরু হয়।
১৯৭৩ সালের দিকে অস্ট্রেলিয়া থেকে কিছু ফ্রিজিয়ান ও জার্সি জাতের ষাঁড় আমদানির মাধ্যমে এ কার্যক্রম নতুন গতি পায়।
দেশী গাইয়ের গর্ভে এসব ষাঁড়ের শুক্রাণু নিষিক্ত করার মাধ্যমে জাত উন্নয়ন ঘটানো হয়।
২০১৪ সালের এক গবেষণায় বলা হয়, সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা গেলে এসব জাতের গরু ভরা মৌসুমে ১ হাজার ৮০০ থেকে তিন হাজার কেজি দুধ উৎপাদনে সক্ষম হবে।
সাধারণত ১৮-২৪ মাসের মধ্যেই সংকর জাতের গরুর বয়োপ্রাপ্তি ঘটে। প্রতিবার বাচ্চা দেয়ার মধ্যবর্তী সময়কাল ১৩-১৫ মাস।
গরুর স্থানীয় এসব জাতের মধ্যে কয়েকটির অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। বিশেষ করে রেড চিটাগং ক্যাটল, নর্থ বেঙ্গল গ্রে ক্যাটল ও পাবনা ক্যাটলের বিলুপ্তির আশঙ্কা রয়েছে।
এগুলোর সংরক্ষণে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া এখন সময়ের দাবি।স্থানীয় গোসম্পদের এ বিপর্যয়ের পেছনে সংশ্লিষ্টদের অনেকেই এখন অপরিকল্পিত প্রজনন কার্যক্রমকে দায়ী করছেন।
তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, এতে দীর্ঘমেয়াদে আমাদের স্থানীয় ও অনন্য জাতের গরুগুলোর বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
একই সঙ্গে এর ফলে প্রজননক্ষম শুক্রাণুর জন্য বাইরের জাতের ওপর নির্ভরতাও ক্ষতিকর মাত্রায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে।
সর্বোপরি স্থানীয় জাতের গরুর অভাব দেখা দিলে গোটা দেশেই গরুর প্রজনন ও জাত উন্নয়নকেন্দ্রিক গবেষণা কার্যক্রম ভেঙে পড়তে পারে।
কারণ সেক্ষেত্রে নির্বাচিত প্রজননের জন্য এ দেশের আবহাওয়া উপযোগী গরুর জেনেটিক বৈশিষ্ট্যের সুবিধাগুলো চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
তবে এ নিয়ে একেবারে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি, তা বলা যাবে না।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০০৪ সালে মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) অর্থায়নে রেড চিটাগং ক্যাটল জাতের গরুর বৈশিষ্ট্য শনাক্তকরণ, সংজ্ঞায়ন, উন্নয়ন ও ব্যবহার নিয়ে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়।
পেন নিউক্লিয়াস ব্রিডিং সিস্টেমের (ওএনবিএস) বৈজ্ঞানিক ধারণা প্রয়োগের ভিত্তিতে প্রকল্পের কার্যক্রম এগিয়ে যেতে থাকে। বর্তমানে মার্কিন বিজ্ঞানীদের সঙ্গে যৌথভাবে প্রকল্পটি এগিয়ে নিচ্ছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।
আর এজন্য স্থানীয় পর্যায়ে কাজে লাগানো হচ্ছে চট্টগ্রামের চন্দনাইশ ও আনোয়ারায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পৃষ্ঠপোষকতাধীন কৃষকদের।দেশের স্থানীয় জাতের গরুগুলোকে টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারি পদক্ষেপ নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।
এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিভিন্ন গবেষণা থেকে উঠে আসা তথ্য-উপাত্ত এবং জ্ঞানকে কাজে লাগানো যায়।
তবে যেকোনো পদক্ষেপের ক্ষেত্রেই কয়েকটি বিষয় বিবেচনার দাবি রাখে।
প্রথমত. কৃষক বা সংশ্লিষ্টদের জীবনমান উন্নয়নে এসব পদক্ষেপ কী ভূমিকা রাখতে পারে।
দ্বিতীয়ত. দুধ ও মাংস তথা আমিষের চাহিদা মেটানোর জন্য কৃষকবান্ধব বাজার ব্যবস্থা গঠন হচ্ছে কিনা।
এক্ষেত্রে কৃষককে বাজারে টেনে না এনে বাজারকেই কৃষকের কাছে নিয়ে যাওয়ার মতো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
তৃতীয়ত. গরুর অপরিকল্পিত প্রজননের বদলে পরিকল্পিত ও সুনির্বাচিত প্রজনন বিষয়ে কৃষক সচেতনতা।
এক্ষেত্রে তাদের স্থানীয় জাতের গরুগুলোর অনন্যতা বোঝানোর মতো পদক্ষেপ নেয়া যায়।
এছাড়া গরুর জাত উন্নয়নবিষয়ক গবেষণা কার্যক্রমে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর মতো কার্যকর পদক্ষেপও নিতে হবে।
(তথ্যঃসংগৃহীত এবং সংকলিত)