Breaking News

কুকুর কাহিনী

আব্বাতো রেগে মেগে আগুন। হারামজাদা বাড়িতে আর কিছু আনার পাইলি না। শেষ মেশ কুত্তার বাচ্চা নিয়ে আসলি।

আমি আগেই জানতাম, এই কুকুরের বাচ্চা নিয়ে আব্বা রাগারাগি করবেন কিন্তু এতটা রেগে যাবেন ভাবিনি। আব্বা বললেন, এক্ষুণি যেখান থেকে এনেছিস ওখানে রেখে আয়। খবরদার এই বাড়ির আশে পাশে যদি এই কুত্তা দেখি তবে তোর আর তোর কুত্তার খবর আছে।

বাড়ির সামনেই বাধা ছিলো। ছোট চাচা ভার্সিটি যাওয়ার সময় বাচ্চাটাকে একটা লাঠি দিয়ে গুতা দিতেই বাচ্চাটা চিৎকার দিয়ে চেচাতে থাকলো। ছোট চাচা আমার দিকে তাকিয়ে হেসে দিয়ে বললো, দেখলাম তোর কুত্তা আওয়াজ দেয় কিনা।

মেজো আপা সোজাসুজি আমাকে জানিয়ে দিলো, তুই যদি এই কুত্তা বাড়িতে রাখিস তবে আমার খাটে তোর শোয়ার জায়গা নেই।
আমি বললাম, আমি কি খাটে কুকৃর নিয়ে ঘুমাবো নাকি?
তুই কুত্তা নিয়ে না ঘুমালেও এই কুত্তাতো তুই পালবি। কুত্তা পালা ছেলে আমার সাথে ঘুমাবে…… ওয়াক তু তু…….

আমার খুব কান্না পাচ্ছে। সবাই কেনো এই কুকুর নিয়ে এমন করছে বুঝতে পারছি না। আম্মার কাছে গেলাম। আম্মার পাশে দাড়িয়ে কিছুক্ষণ কাঁদলাম। আম্মার একটু দয়া হলো। আমাকে বললো, বাড়ির পেছনে বেঁধে রাখ। কেউ যেন না জানে এই কুকুর বাড়িতে আছে।

এরপর শুরু হলো আমার কুকুর পোষা। আম্মা বোধহয় আব্বাকে কিছু একটা বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বলেছেন। কুকুর নিয়ে আব্বার হৈচৈ কমে গেল। কুকুরটা বাড়ির পেছনে বাঁধা থাকে। বাড়ির সামনেও তেমন একটা আনি না। এভাবে চলতে থাকলো। আমার কুকুরের একটা নামও দিলাম। টাইগার। ছোট চাচা হাসেন। বলেন, তোর কুত্তা দেখি বাঘ হয়ে গেল রে।
এই নিয়ে আমি ছোট চাচার সাথে কথা বাড়ায় না। মেজো আপাও সব সময় কেমনজানি করে। শুনেছি, আমি স্কুলে গেলে সুযোগ পেয়ে দু-চারটা গুতাও মারে কুকুরটাকে। এই নিয়ে মেঝ আপার সাথে আমার অনেকবার লেগেছে।

আমার কুকুরটা বড় হতে থাকলো। বাড়ির ঝুটা খাবারই ভরসা। কুকুরটার হাড্ডি ভীষণ প্রিয়। আমাদেরতো আর রোজ রোজ মাংস রান্না হয়না। তবে মোজ্জামেলরা বড়লোক। যেদিন ওদের মাংস রান্না হয় মোজ্জামেল হাড্ডিগুলো লুকিয়ে রাখে। আমি গিয়ে নিয়ে আসি। এভাবে চলতে থাকলো। আস্তে আস্তে কুকুরটা বড় হয়ে গেল অনেক। এখন তাকে বেঁধে রাখিনা। পুরো বাড়ি এখন সে ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়ায়।

আব্বা ফজরের নামাজ পড়তে রোজ মসজিদে যান। আমার এই কুকুরটা আব্বার পেছন পেছন মসজিদের কাছে গিয়ে দাড়িয়ে থাকে। মসজিদ থেকে ফেরার সময়ওে আব্বার পেছন পেছন বাড়িতে আসে। কেনজানি এখন আব্বা বিরক্ত হননা। অফিস থেকে ফিরে এই কুকুরটাকে না দেখলেই আম্মাকে জিজ্ঞেস করে, টাইগারকে দেখছি না যে।

আমার ভীষণ ভালো লাগে। ভীষণ। আমাদের সব ভাইবোনের মত এই কুকুরের জন্যও যেন আব্বার একটা মায়া তৈরী হয়ে গেছে। আব্বাতো খুব ছোট একটা চাকরি করেন। আমাদের খাওয়া দাওয়া খুব হিসেব করে। মাংস খুব একটা রান্না হয়না। যেদিন রান্না হয় আব্বা খাওয়ার সময় হাড্ডির সাথে লাগানো মাংসটা পুরো না খেয়ে একটুখানি মাংস রেখে দেন। খাওয়া শেষ করে আমাকে বলেন, এই হাড্ডিগুলো টাইগারকে দিয়ে আয়। আম্মা, ছোট চাচা, মেজো আপা, ছোট আপা, সাজিদ, সবাই দেখি ভীষণ আদর করে টাইগারকে। যে মেজো আপা দুচোখে দেখতে পারতো না সেই মেজো আপা আব্বার পুরনো একটা বেল্ট কেটে টাইগারের গলায় পরিয়েছে। বললো, এই বেল্ট দেখলে কেউ আমাদের টাইগারকে মারবে না। সবাই বুঝবে এটা কারো পালা কুকুর।

সেবার ভীষণ শীত পড়লো। ভীষণ বলতে ভীষণ। প্রয়োজন ছাড়া আমরা কেউ বাইরে বের হইনা। আব্বা অফিস থেকে ফিরে এসে দেখলো টাইগার বাড়ির আশে পাশে নেই। আব্বা অনেক ডাকাডাকি করলো। টাইগারের কোন সাড়া শব্দ না দেখে আমিও ভয় পেয়ে গেলাম। বাড়ির চারপাশে খুঁজে দেখি কোথাও নেই। এ্ই শীতের মধ্যে আব্বা, আমি, ছোট চাচা সবাই সাধ্যমত সব জায়গায় খোঁজ নিলাম। রাত প্রায় বারোটা অবধি আমরা অনেক খুঁজলাম কিন্তু টাইগারের কোন খোঁজ পেলাম না।

আমার খুব কান্না পাচ্ছে। মন খারাপ করে শুয়ে আছি। কিছুতেই ঘুম আসছেনা। ফজরের আজানের সময় আব্বা নামাজে গেলেন। রোজ দিন আব্বা নামাজ শেষ করে এসে আরেকটু ঘুমান। আজ ঘুমালেন না। আমি উঠে আব্বার কাছে গেলাম। আব্বা ভীষণ রাশভারি মানুষ। আমরা সাধারাণত আব্বাকে ভীষণ ভয় পাই। আমাকে দেখে আব্বা কাছে ডাকলেন। আমি আব্বার কাছে গিয়ে বসলাম। আব্বা আমার মাথায় হাত বুলাতেই আমার ভীষণ কান্না পেল। আমি আব্বাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছি। কেনজানি আব্বাও কাঁদছেন। এই মানুষটাকে আমি কখনো কাঁদতে দেখিনি। আমাদের কান্না দেখে মেজো আপা আর আম্মাও কাঁদছেন। আমি কখনোই জানতাম না এই একটা কুকুরকে তারা এতটা ভালোবাসেন।

আমার খুব মনে আছে। তেইশদিন পার হলো। আমি, আব্বা, ছোট চাচা যে যার যার মত খুঁজে চলছি আমাদের টাইগারকে। কিন্তু কোথাও টাইগারের খোঁজ নেই। আমরা আশা একেবারেই ছেড়ে দিলাম।

সেদিন সন্ধ্যা রাত থেকে আব্বার জ্বর উঠলো। ভীষণ জ্বর। জ্বরের ঘোরে আব্বা নানা আবোল তাবোল বকছেন। তার মধ্যে উনি বার বার বলছেন, খসরু দেখ টাইগার আসলো কিনা। আমি বাইরে গিয়ে দেখি। না টাইগার আসেনি। আমি আব্বাকে এসে বললাম, আব্বা টাইগারতো আসেনি। আব্বা কিছু বলেন না। আব্বাকে জ্বরের ওষুধ দেয়া হয়েছে।

আব্বা আমাকে কাছে ডাকলেন, জ্বরের মধ্যেই আব্বা বললো, সেদিন ভোরে আমি খুব বকেছিলাম রে টাইগারকে। কি দরকার ছিলো ঐ কালো কুকুরটার সাথে ঝগড়া করার। এ্ ভোর বেলায় মসজিদের সামনে কালো কুকুরটার সাথে মারামারি করলো। আমি মসজিদ থেকে বের হয়ে মারামারি থামালাম। তারপর রাগ করে টাইগারকে দুটা মেরেওছিলাম। আমি জানি টাইগার অভিমান করেছে। তুই দেখিস টাইগার ফিরে আসবে। অবশ্যই আসবে।
কথাগুলো আব্বা এক নাগাড়ে বলে গেলেন। জ্বর একটু কমতেই আব্বা ঘুমিয়ে পড়লো।

মাঝ রাতে টাইগারের আওয়াজ শোনা গেল। বাইরে চিৎকার করছে। সবার আগে আব্বা দৌড়ে গেলেন। উঠানে দাড়িয়ে থাকা আমাদের টাইগারকে আব্বা হাঁটু গেড়ে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করছেন। আব্বা ঠিক বাচ্চাদের মত জিজ্ঞেস করছেন, কোথায় ছিলি এতদিন্? কোথায় ছিলি?

আব্বার চোখে পানি। আমরা সবাই কাঁদছি। খুশির কান্না।

——কুকুর…
——রুহুল আমিন

Please follow and like us:

About admin

Check Also

বিড়াল পর্ব ঃ

বিড়াল পর্ব ঃ১ আজকে আলোচনা করবো ইন্টারেস্টিং একটা বিষয় নিয়ে,,, বিড়াল কবে থেকে পোষ মানে?? …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Translate »