ইনকিউবেটর এবং মুরগী দিয়ে ডিম ফুটানো :
ইনকিউবেটর চালাতে গিয়ে যখন ডিম
ফোটার উপযোগী আবহাওয়া
সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রন করা আমাদের
কাছে কঠিন হয়ে পড়ে, তখন আমাদের
মনে একটা প্রশ্ন আসে, সেটা হচ্ছে,
মুরগী বা কোনো পাখি কিভাবে
ডিম ফোটার সাথে যুক্ত বিষয়গুলো
নিয়ন্ত্রনে রাখে
বা
কোনো পাখি ডিমে তা দিয়ে ডিম
ফুটানো এবং ইনকিউবেটরের
সাহায্যে ডিম ফুটানোর মধ্যে
পার্থক্য কি.!
আজকের এই পোষ্টে সেই বিষয়গুলো
সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো।
.
ডিম থেকে বাচ্চা ফুটানোর জন্য মূল বিষয় গুলো হচ্ছে,
(১)সঠিক তাপমাত্রা,
(২)সঠিক আদ্রতা,
(৩) ডিমে অক্সিজেন সরবরাহ করা।
(৪)সঠিক সময় ডিম ঘুরানো।
।
ইনকিউবেটর হচ্ছে কৃত্যিমভাবে ডিম
ফোটার উপযোগী আবহাওয়া তৈরি
করে ডিম থেকে বাচ্চা ফুটানোর
মেশিন।
মূলত এক সাথে অনেক ডিম ফুটানোর
জন্য ইনকিউবেটর ব্যবহার হয়ে থাকে।
একই সাথে বেশি পরিমান ডিমে
সমান আবহাওয়া রাখা সহজ হবে এমন
ডিজাইনে ইনকিউবেটর মেশিন
তৈরি করা হয়।
মুরগী দিয়ে ডিম ফুটানো এবং
ইনকিউবেটরে ডিম ফুটানোর
ক্ষেত্রে মূল বিষয় গুলো একই রকম হলেও
ইনকিউবেটরে উক্ত বিষয় গুলো
সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রনের ক্ষেত্রে
কিছুটা জটিলতা রয়েছে।
।
*উমে বসা মুরগীর শরীরের তাপমাত্রা
ডিম ফোটার জন্য আদর্শ তাপমাত্রার
চেয়ে সমান্য বেশি থাকে, মুরগীর
শরীর থেকে ডিমে তাপ পরিবাহীত
হয়ে ডিম যতটুকু উত্তাপ্ত হয় সেটাই ডিম
ফোটার জন্য আদর্শ তাপমাত্রা।
যখন কোনো যন্ত্রের সাহায্যে
তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রন করা হয় তখন সেই
যন্ত্রটি সেন্সরের সাহায্যে
তাপমাত্রা নির্ণয় করে সেন্সরের
কাছে সঠিক তাপমাত্রা বজায়
রাখার জন্য তাপের উৎসকে নিয়ন্ত্রন
করে।
অন্যদিকে মুরগী যখন ডিমের উপর বসে
থেকে ডিমে তাপ দেয় তখন মুরগীর
শরীর একই সাথে তাপের উৎস এবং
সেন্সরের মত কাজ করে ডিমে
নিরবিচ্ছিন্ননভাবে সঠিক
তাপমাত্রা বজায় রাখে,
যার কারনে মুরগী দিয়ে ডিম ফুটালে
ডিম ফোটার হার বেশি থাকে।
* ইনকিউবেটরের ভিতরে সকল ডিমে
সঠিক তাপমাত্রা বজায় রাখাটা
বেশ কঠিন কাজ, কারন তাপমাত্রা
নিয়ন্ত্রনের সেন্সর একস্থান থেকে
হাজার হাজার ডিমের চারপাশের
তাপমাত্রা সমানভাবে শনাক্ত করতে
পারবেনা।
সেন্সর থেকে ডিমের দুরুত্ব এবং ডিম
থেকে হিটারের দুরত্ব যত বাড়বে
তাপমাত্রা পার্থক্য হবার সম্ভবনা তত
বাড়বে। কারন আমরা জানি শূণ্য
মাধ্যমে ধীরে তাপ পরিবাহীত হয়।
তাই সকল ডিমে দ্রুত তাপমাত্রা
পৌছানোর জন্য একটা বা একাধিক
ফ্যনের সাহায্য ইনকিউবেটরের
ভিতরের বাতাস ঘূর্ণায়ন করা হয়।
।
উক্ত চারটি বিষের মধ্যে প্রথম তিনটা
বিষয় (তাপমাত্রা,আদ্রতা,
অক্সিজেন।) বাতাসের সাহায্যে
সকল ডিমে পৌছানো সম্ভব, সেই
কারনে ইনকিউবেটরে এ্যয়ার
সার্ক্লুয়েশনের বা বাতাস ঘূর্ণায়নের
বিষয়টাকে অনেক গুরুত্বের সাথে
দেখা হয়।
।
*আদ্রতা নিয়ন্ত্রনঃ
আদ্রতা নিয়ন্ত্রনের মুল উদ্দেশ্যই হচ্ছে
ডিমের ভিতরের তরলকে সঠিক
পরিমানে রাখা।
.
ডিমের ভিতরের জ্বলীয়অংশ সঠিক
পরিমানে বজায় রাখার জন্য দুইটা
পদ্ধতী ব্যবাহার করা যেতে পারে।
* প্রথমতঃ তাপমাত্রার তারতম্য
ঘটিয়ে।
তাপমাত্রার তারতম্য ঘটালে সরাসরি
ডিমের তরল বাস্পায়ীত হাওয়ার
বিষয়টাকে নিয়ন্ত্রন করা যায়।
বিষয়টা পরিক্ষার জন্য একটা পাত্রে
পানি রেখে পাত্রে চতুরপাশ্বে
সামানভাবে তাপ দিন এতে দেখবেন
পাত্রের পানিটা খুব দ্রুত শুকিয়ে
যাচ্ছে।
এবার ঐ পানির পাত্রের নিচে তাপ
দিন এবং উপরে ঠান্ডা বাতাস
প্রবাহিত করুন অথবা অন্য কোনো
উপায়ে পানির উপরের স্তর ঠান্ডা
রাখুন দেখবেন আগের মত খুব দ্রুত পানি
বাস্পায়ীত হচ্ছেনা এভাবেই
তাপমাত্রার তারতম্য ঘটিয়ে তাপ
দেবার মাধ্যমে ডিমের জ্বলীয় অংশ
শুকানোর মাত্রাকে নিয়ন্ত্রনে
রাখা সম্ভব।
*দ্বিতীয়তঃ বাতাসে সঠিক পরিমান
জ্বলীয় বাস্প বা আদ্রতা বজায় রেখে,
এই পদ্ধতীটা সাধারনত ইনকিউবেটরে
ব্যবহার করা হয়।
।
যেহুতু তাপমাত্রার উপর নির্ভর করে
ডিম শুকিয়ে যায়, তাই তাপমাত্রার
তারতম্য ঘটিয়ে ডিমের ভিতরের
জ্বলীয়অংশ বাস্পায়ীত হওয়ার
বিষটাকে নিয়ন্ত্রনে রাখা যায়।
।
মুরগী মূলত তাপমাত্রার সাহায্যে
ডিমের ভিতরের তরল শুকিয়ে যাবার
মাত্রাকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রনে
রাখে যে হ্যচিংয়ের সময় অতিরিক্ত
পানি দ্বারা বাহিরে আদ্রতা
বাড়ানোর প্রয়োজন পড়েনা।
।
আদ্রতা তৈরি বা ডিমের ভিতরের
তরল বাস্পায়ীত হবার সাথে মূল সম্পর্ক
হচ্ছে তাপমাত্রার, তাপমাত্রা যত
সমানভাবে ডিমের সাবখানে
থাকবে ততদ্রুত ডিম শুকাতে থাকবে,
আমরা হয়তো লক্ষ করেছি মুরগী
ডিমের একপাশ থেকে অর্থাৎ ডিমের
উপর থেকে ডিমে তাপ দেয়, ডিমের
উপরে অপেক্ষা ডিমের নিচের
তাপমাত্রার পার্থক্য থাকে এইভাবে
তাপ দেয়ার মাধ্যমেই ডিমের তরল
শুকানোর মাত্র সঠিকভাবে থাকে।
মূলত ডিমের উপরে এবং নিচের
তাপমাত্রার তারতম্য ঘটার কারনে
ডিম শুকানোর কাজটা সঠিকভাবে
নিয়ন্ত্রনে থাকে, এবং ঐস্থানে ডিম
ফুটার জন্য আদর্শ আদ্রতা বজায় থাকে,
শীতকালে এইকাজটা আরো
নিখুঁতভাবে সম্পূর্ণ হয় যারকারনে
গরমকাল অপেক্ষা শীতকালে
হ্যচিংরেট বেশি আসে।
মুরগী ডিমের তরলকে এত জটিল
প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রনে রাখে যেটা
কোনো যন্ত্রের সাহায্যে অতটা
নিখুঁতভাবে নিয়ন্ত্রনে রাখা সম্ভব
নয়।
।
*নিদৃষ্ট তাপমাত্রায় বাতাসের
জ্বলীয় বাস্প ধারন ক্ষমতা একটা
নিদৃষ্ট লেভেলে থাকে, তাই
বাতাসে নিদৃষ্ট জ্বলীয়বাস্প
বিদ্যমান রাখা হয় যাতে ডিমের
থেকে খুব বেশি পরিমানে পানি
বাতাস শুষে নিতে নাপারে।
ডিমের ভিতরের তরলকে সঠিক
পরিমানে রাখার জন্য ইনকিউবেটরর
ভিতরে বাতাসে সঠিক আদ্রতা
রাখা হয়।
ইনকিউবেটরে আদ্রতা বাড়ানোর জন্য
হিমিডিটিফায়ার ব্যবহার করা হয়,
এবং আদ্রতা কমানোর জন্য
ডিহিমিউডিটিফায়ার অথবা এ্যয়ার
ভ্যন্টিলেশেন করিয়ে আদ্রতা
কমানো হয়।
ট্যম্পারেচার সেন্সের মত
হিমিউডিটি সেন্সরও শুধু মাত্র
সেন্সরের কাছের আদ্রতাকে
সঠিকভাবে শনাক্ত করতে পারে,তাই
সব স্থানে সমানভাবে আদ্রতা রাখার
জন্য ইনকিউবেটরের ভিতরে একটা বা
একাধিক ফ্যন সারাক্ষন অথবা
টামিংয়ের মধ্যমে চালু রাখা হয়।
ইনকিউবেটরের উপরে অপেক্ষা নিচে
আদ্রতা বেশি থাকে তাই সকল
ইনকিউবেটরেই নিচে হ্যচিং ট্রে
রাখা হয় কারন হ্যচিংয়ের সময় আদ্রতা
বেশি রাখতে হয়।
.
*ডিম ঘুরানো।
ডিমে তাপ দেবার সময় ডিম যে অংশ
উপরে থাকে সেই পাশ থেকই ভ্রুনের
উন্নয়ন শুরু হয়। তাই ডিমের একটা পাশ
যদি দীর্ঘদিন উপর দিকে থাকে
তাহলে নিচের চেয়ে উপর দিকটাতে
ডিমের বাচ্চার বৃদ্ধি বেশী হয়,
এতে যেমন বাচ্চার সঠিক গঠন
বাঁধাপ্রপ্ত হয়, তেমনি ডিমের
একপাশে বাচ্চার বৃদ্ধি হবার কারনে
অধিকাংশ বাচ্চা ডিম থেকেবের
হতে গিয়ে মারা যায়।
তাই ডিমের ভিতরে বাচ্চাকে
সঠিকভাবে বৃদ্ধিতে সহায়তা করার
জন্য একটা নিদৃষ্ট সময় পর পর ডিমকে
ঘুরিয় দিতে হয়, এতে ভ্রুন ডিমের
খোসার সাথে লেগে যাবার
সম্ভবনা থাকেনা।
*মুরগীর ডিম ঘুরানোর বিষয়টা খুব
সাধারণ ভাবেই হয়ে থাকে।
মুরগী উমে বসে থাকাকালীন মাঝে
মাঝে ভিন্ন ভিন্ন ঘুরে বসে থাকে
আর এই দিক পরিবর্তনের ফলে যে ডিম
গুলো মুরগী পেটের নিচ থেকে একটু
বেরিয়ে যায় মুরগী সেই ডিম
গুলোকে ঠোঁট দিয়ে পেটের নিচে
ঢুকিয়ে নেয়, এতে ডিম ভিন্ন ভিন্ন
কোনো ঘুরে থাকে, আর এই সামান্য
নড়াচড়াতেই ডিম ঘুরানোর কাজটা
সম্পূর্ণ হয়।
।
*ইনকিউবেটরে হাজার হাজার ডিম
এক সাথে ঘুরানো হয়, তাই মুরগীর মত
ভিন্ন ভিন্ন কোনো ডিম ঘুরানোর
প্রক্রিয়াটা ইনকিউবেটরের ক্ষেত্রে
অনেক জটিল, সেই কারনে একটা ট্রের
ফ্রেমে ডিম গুলো কে আটকে রেখে
পুরো ট্রেটাকে নিদৃষ্ট কোনে
ঘুরানো হয়।
।
*অক্সিজেন সরবরাহ।
পৃথীবীতে প্রতিটা প্রাণীর জীবন
ধারনের জন্য অক্সিজেন প্রয়োজন,
তেমনি ডিমের ভিতরে থাকা
ভ্রুনেরও অক্সিজের প্রয়োজন পড়ে,
যদিও সেটা খুবই স্বল্প পরিমান।
আমাদের চারপাশের বাতাসে
অক্সিজেনের পরিমানটাই সবচেয়ে
বেশি,
ইনকিউবেটরে এ্যয়ার ভ্যন্টিলেশনের
মাধ্যমে বাহিরের বাতাস
ইনকিউবেটরের ভিতরে প্রবেশ
করানো হয়, এতেই অক্সিজেন
সরবরাহের কাজটা হয়ে যায়,
তবে হ্যচিংয়ের সময় যেহেতু আদ্রতা
কমে যাওটা ঝুঁকিপূর্ণ তাই অধিকাংশ
ইনকিউবেটরে ভ্যন্টিলেশন টাইম
কমিয়ে দেয় এবং আদ্রতা তৈরির
পানি চেক করার জন্য দিনের মধ্যে
১/২বার ইনকিউবেটর খুলেন এতেই
ইনকিউবেটরের ভিতরে পর্যাপ্ত
পরিমান অক্সিজেন প্রবেশ করে।
*মুরগী পেটের নিচের ডিম গুলো
ইনকিউবেটরের ভিতরের ডিমের মত
বদ্ধ অবস্থায় থাকেনা,মুরগীর পেটের
নিচে দিয়ে বায়ূচলাচল করতে পরে
যার কারনে অক্সিজেন সরবরাহের
কাজটা সহজেই সম্পূর্ণ হয়।
.
মূরগী ডিমে তাপ দিয়ে ডিম
ফুটানোর নিয়মটা প্রাকৃতীক, আর
ইনকিউবেটরে ডিম ফুটাতে প্রাকৃতীক
নিয়মকে বৈজ্ঞানিক সূত্র দ্বারা
অনুশরন করে একই সাথে হাজার হাজার
ডিম ফুটানোর প্রক্রিয়াকে সহজ করা
হয়।
একটা ডিমের ভিতরে ছোট্ট ভ্রুন
থেকে বাচ্চায় রুপান্তরিত হয়ে
বাচ্চা বের হওয়া পর্যন্ত যা কিছুর
প্রয়োজন পড়ে সবকিছুই ডিমের ভিতরে
সঞ্চিত থাকে,
আর মুরগী ডিম ফুটানোর সময় সেই
সঞ্চিত উপাদান গুলোর সঠিক ব্যবহার
নিশ্চিত করে ।
ইনকিউবেটর যত আধুনিকই হোক না
কেনো তা কখনোই প্রকৃতিক নিয়মকে
শতভাগ অনুশরন করতে পারবেনা।
লেখকঃ আব্দুল ওহাব