Breaking News

অর্থনীতির সঞ্জিবনী হতে পারে যুগোপযোগী প্রাণিসম্পদ খাত ডা. মো. নূরে-আলম

প্রেক্ষিত কোরবানি
অর্থনীতির সঞ্জিবনী হতে পারে যুগোপযোগী প্রাণিসম্পদ খাত
ডা. মো. নূরে-আলম

গত কোরবানির ঈদের জন্য দেশে এক কোটি ১৮ লাখ ৯৭ হাজার ৫শটি গবাদিপশু মজুদ ছিল। যার মধ্যে হৃষ্টপুষ্টকৃত গরু-মহিষের সংখ্যা ৪৫ লাখ ৩৮ হাজার এবং ছাগল-ভেড়ার সংখ্যা ছিল ৭৩ লাখ ৫৫ হাজার। এছাড়াও অন্যান্য প্রাণি ছিল চার হাজার ৫০০টি; যা প্রয়োজনের তুলনায় পর্যাপ্ত বলে জানিয়েছিলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম।

প্রতিটি গরু-মহিষের মূল্য এক লাখ টাকা গড় হিসেবে মূল্য হয় ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা এবং প্রতিটি ছাগল, ভেড়া ও অন্যান্য প্রাণি ১০ হাজার টাকা গড় হিসাব মূল্য সাত হাজার ৩৬০ কোটি টাকা। সুতরাং শুধুমাত্র কোরবানির ঈদ উপলক্ষে প্রাণিসম্পদের জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান ৫২ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা। করোনাকালীন মহামন্দার সময়ে অর্থনীতির চাকা সচল করতে এই অর্থ বিশেষ ভূমিকা রেখেছে, তা সন্দেহাতীত। যা সম্পূর্ণ বাস্তবসম্মত ও বিগত চার বছরের সাফল্যের ধারাবাহিকতায় উদ্ভাসিত সত্য।

কেবল কোরবানির পশু কেনা-বেচা নয় বরং কোরবানিকে কেন্দ্র করে দেশে সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতিশীল হয়েছে। ঈদের কেনাকাটার পাশাপাশি গো-খাদ্য, রশি, চামড়া, ভোজ্য তেল, মসলা, হাঁড়ি-পাতিল, দা, বটি, পরিবহনসহ স্থানীয় মুদি দোকান থেকে শুরু করে থমকে যাওয়া সুপার মার্কেট, শপিং মলসহ সকল বিপণী কেন্দ্রে বেচাকেনা শুরু হয়েছে। কোরবানির কারণে গতি এসেছে সামগ্রিক অর্থনীতিতে।

চামড়া খাতের মূল বাজার চার থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকা হলেও এর সঙ্গে জড়িত ভ্যালু এডিশনসহ এ খাতে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়। তাছাড়া কোরবানির অন্যান্য অনুসঙ্গ পেঁয়াজ, রসুন, আদাসহ গরম মসলা বিশেষ করে এলাচি, দারুচিনি, লবঙ্গ, জিরা, তেজপাতার উল্লেখযোগ্য অংশ কোরবানিতে ব্যবহার হয়। কোরবানির বাজারে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হবে এসব পণ্যের। অর্থনীতিবিদদের মতে ছুরি, বঁটি, দা, চাপাতি, কুড়াল, রামদা, শান পাথর ইত্যাদি মিলে কোরবানিতে পণ্যগুলোর বাজার এক হাজার কোটি টাকার বেশি।

পোল্ট্রি খাত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শিল্প, ডেইরি ইন্ডাস্ট্রি একটি উদীয়মান ও প্রতিষ্টিত শিল্প। যাদের কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে গ্রামীন অর্থনীতি। শুধু তাই নয় দেশী-বিদেশী সহস্রাধিক কোম্পানি ব্যবসা করছে এ খাতে। কেবল ব্রয়লার হতে তৈরি হয় ৫০০র বেশি ধরনের খাবার, দুধ থেকে শতাধিক পণ্য! হাজারো ফিড মিল, মেডিসিন উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, হ্যাচারি, ব্রিডার, প্যারেন্ট, বানিজ্যিক খামার, বিক্রয়, পরিবহণ ব্যবস্থা গড়ে উঠার পাশাপাশি চিকেন ও মিট প্রসেসিং প্লান্ট সমূহ গড়ে উঠছে। বেকারি পণ্যে দুধ, ডিমের ব্যবহার সর্বজন বিধিত। সাথে আছে ব্যাকইর্ড পোল্ট্রি ও অন্যান্য গবাদিপশু যা গ্রামীণ অর্থনীতিতে জীবন্ত ব্যাংক হিসেবে কাজ করছে, শুধু পুষ্টির চাহিদা পূরণ নয় বরং নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষা, চিকিৎসা ও জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। হাওড়, নদীতে কোটি হাঁসের আনাগুনা যেন দৃষ্টির বাইরেই থেকে যাচ্ছে!

পরিবর্তিত খাদ্যাভ্যাসের কারণে মানুষ দিন দিন প্রাণিজ আমিষের দিকে ঝুঁকছে। ৮০ শতাংশ প্রোটিন সরবরাহের মাধ্যমে পুষ্টি নিরাপত্তার পাশাপাশি মোট শ্রম শক্তির ২০ শতাংশ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৫০ শতাংশ প্রাণিসম্পদ খাতের সাথে জড়িত।

শিক্ষিত বেকার জনগোষ্টির কর্মসংস্থানের বৃহত্তম খাত হতে পারে প্রাণিসম্পদ খাত। দেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য প্রাণিসম্পদের গুরুত্বপূর্ণ উপপণ্য বা উপজাত পণ্য। শিল্পোৎপাদন ও জিডিপিতে অবদান যথাক্রমে ২ শতাংশ ও ০.৬ শতাংশ যা সর্ম্পূণ প্রাণিসম্পদের অবদান। ২০১৭-১৮ বছরে রপ্তানিতে তৈরি পোষাকের পরই চামড়া শিল্পের অবদান। ২০১৭ সালকে বাংলাদেশ সরকার চামড়া, চামড়াজাত পন্য এবং চামড়াজাত পাদুকাকে ‘Products of the Year’ ঘোষণা করেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের চামড়া খাতের রপ্তানি রূপরেখা অনুসারে ২০২৫ সালের মধ্যে চামড়া রপ্তানিতে বিশ্বের প্রথম ১০টি দেশের ভিতর নিয়ে আসা, ২০২১ সালের মধ্যে ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার রফতানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।

আমরা জানি জিডিপিতে প্রাণিসম্পদের অবদান দুধ, ডিম, মাংস- হাঁস, মুরগি, টার্কি, কোয়েল, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেঁড়া সব মিলে) ৪৩ হাজার ২১৫ কোটি টাকা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে শুধু কোরবানির ঈদ উপলক্ষ্যেই অবদান ছিল ৫২ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা। অতএব জিডিপির বর্তমান হিসাব কোনভাবেই বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। অতএব জিডিপিতে প্রাণিসম্পদের সত্যিকার অবদান হবে বর্তমান তথ্য হতে অনেক বেশি।

করোনার কারণে দেশের ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে, যাদের আয় কম, তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বিরাট অংশের মানুষের কাছে দুমাস চলার মতো অর্থ নেই। যদি পরিস্থিতি এরকম চলতে থাকে সেক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের আয় ২৫ ভাগ কমে যাবে ফলে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখা আরো ২০ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে।

জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) সূত্র বলছে, প্রায় এক কোটি বাংলাদেশী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকেন। একটি বড় অংশ কাজ করে চুক্তিভিত্তিক তাছাড়া কয়েক লাখ আছেন, যাঁদের বৈধ কাগজপত্র নেই। এখন তাদের আয় পুরোপুরি বন্ধ, মহাসংকটে পড়েছেন তারা।

উচ্চশিক্ষিত শিল্পপতি হতে গ্রামাঞ্চলের ভূমিহীন, প্রান্তিক, দুস্থ, বেকার শ্রেণীর ‘জীবন্ত ব্যাংক’ হিসেবে কাজ করে প্রাণিসম্পদ ও পোল্ট্রি। যে ব্যাংকের তহবিল প্রায় ১৮ কোটি মানুষের ৮০ শতাংশ প্রাণিজ আমিষের পুষ্টির যোগান দিচ্ছে তাই নয় বরং স্বাস্থ্য, শিক্ষা, এমনকি ৭০ শতাংশ শ্রমশক্তির বেকারত্ব দূরীকরনে বিশেষ ভূমিকা রাখছে।

এজন্য উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে উন্নয়নের মহাসড়কে চলতে প্রাণিসম্পদ বিভাগকে হতে হবে আরো আধুনিক, যুগোপযোগি এবং করতে হবে এ খাতের টেকসই উন্নয়ন যা নিশ্চিত করবে নিরাপদ প্রাণিজ আমিষ তথা পুষ্টি নিরাপত্তা। অতএব প্রাণিসম্পদ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি বিশেষ করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও রাষ্ট্রীয় পলিসি মেকারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি যেন জিডিপিতে প্রাণিসম্পদের সঠিক মূল্যায়ন করা হয়, প্রাণিসম্পদ খাতকে জরুরি সেবার অন্তর্ভুক্ত করা হয়, লোকবল কাঠামো আধুনিকায়ন করা সহ প্রশাসনিক গতিশীলতা আনয়নের মাধ্যমে বিশাল জনগোষ্ঠীর অথনৈতিক মুক্তি ও বেকারত্ব হ্রাস করার ব্যবস্থা করা হয়।

লেখক: ভেটেরিনারি সার্জন, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর।

Please follow and like us:

About admin

Check Also

পোল্ট্রি খামারীদের বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানব বন্ধনঃ

খাবারের ও বাচ্চার দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে লাখ লাখ তরুণ পোল্ট্রি খামারী সহ ৬০লাখ লোক …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Translate »