ভিনেগাররের_ঔষধিক_ব্যবহার_ও_সুস্থ_খামার_ব্যবস্থাপনা
ভিনেগার এসিটিক এসিডের (CH3COOH) ৬-১০% ও পানির মিশ্রণে তৈরি | চিনি বা ইথানলকে গাজন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এসিটিক এসিডে পরিণত করা হয়। গৃহস্থালী পরিস্কার, পুড়ে যাওয়া, চিকিৎসায় পথ্য ইত্যাদি বহুবিধ ক্ষেত্রে এর স্বার্থক প্রয়োগ ঘটেছে।ভিনেগার হাজার হাজার বছর পূর্বে তৈরি করা হয়েছে এবং মানুষের দ্বারা ব্যবহৃত। ৩০০০ খ্রি.পূর্বে মিশরে এটি পাওয়া যায়।
চতুর্দশ শতাব্দীতে একজন মুসলিম চিকিৎসা-বিজ্ঞানী ইবনে কাইয়ুম আল-যাওজিয়া তার ‘দা প্রফেটিক মেডিসিন’ গ্রন্থে ভিনেগারের উপকারিতার কথা লিপিবদ্ধ করেছেন। ভিনেগার নিয়ে প্রচলিত একটি ফরাসি প্রাচীন গল্প যা না বললে অন্যায় হবে। গল্পটি এমন: ফ্রান্সের কুখ্যাত ‘ব্ল্যাক প্লেগ’ বা ‘কৃষ্ণ মহামারী’র সময়ে তিনজন চোর এক মহামারী আক্রান্ত ব্যক্তিদের বাড়িতে বার বার চুরি করেও মহামারীতে আক্রান্ত হলো না। শেষ পর্যন্ত তারা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লো। বিচার প্রক্রিয়ার সময় যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিল তা হচ্ছে: কী করে চোর তিনজন মহামারী আক্রান্তদের বাড়িতে দিনের পর দিন চুরি করেও রোগাক্রান্ত হলো না! বিচারক বললেন, তোমাদের মুক্তি দেওয়া হবে, যদি তোমরা এর গোপন রহস্য আমাদের বল। চোরেরা জানালো, তারা একজন মহিলা চিকিৎসকের কাছ থেকে নেওয়া একধরনের তরল নিয়মিত পান করে। আসলে সেই তরল ছিল ভিনেগার বা সিরকা। পরে এই সিরকা ‘তিন চোরের সিরকা’ নামে ফ্রান্সে শত শত বছর ধরে টিকে থাকে।
ভিনেগারে বিভিন্ন রকমের ফলমূল যেমন: আপেল, আঁখ, নারিকেল, খেজুর, নাশপাতি, টমেটো; শস্য হিসেবে চাউল, গম সহ মধু দিয়ে প্রস্তুত করা হয়। এ সকল ফল বা শস্যের নামানুসারে ভিনেগারের নামকরণ করা হয়ে থাকে।
ভিনেগারের অনেক স্বাস্থ্য উপকারিতাও আছে । আমাদের দেশে সাধারণত সাদা ভিনেগার বেশি ব্যবহার করা হয়। এক টেবিল চামচ সাদা ভিনেগারে পেতে পারেন ০.৯ গ্রাম শর্করা, ০.৯ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ০.১ মিলিগ্রাম ম্যাগনেসিয়াম। এক টেবিল চামচ বলস্যামিক ভিনেগারে ৩.৭ মিলিগ্রাম সোডিয়াম, ৩ গ্রাম শর্করা, ৩ মিলিগ্রাম ফসফরাস এবং ১৭.৯ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম আছে। অপরদিকে এক টেবিল চামচ পরিমাণ অ্যাপেল সিডার ভিনেগারে ১ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ০.৭ মিলিগ্রাম ম্যাগনেসিয়াম, ১.২ মিলিগ্রাম ফসফরাস এবং ১০.৮ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম ।
বিভিন্ন ধরনের ভিনেগার হয়ে থাকে যেমনঃ—–
? সাধারন ভিনেগার বা সাদা ভিনেগার
সারা বিশ্বেই বহুল প্রচলিত সাদা ভিনেগার। ইথানল বা পরীক্ষাগারের অ্যাসিটিক অ্যাসিড থেকে তৈরি হয় এবং পরে পানি দিয়ে আরও পাতলা করা হয়।
?অ্যাপল সিডার ভিনেগার (Apple cyder vineger)
দ্বিতীয় বহুল পরিচিত ভিনেগার হিসেবে যার নাম আসবে, সেটা অ্যাপল সিডার ভিনেগার। আপেলের নির্যাস থেকে যা তৈরি হয় পানি আর চিনি বা মধু মিশিয়ে।
? নারকেল ভিনেগার
নারকেলের পানি দিয়ে তৈরি ভিনেগার। নারকেল ভিনেগার দেখতে অনেকটা মেঘলা আকাশের মতো।
? বালসামিক ভিনেগার
নাম বালসাম হলেও এখানে কোনো ধরনের উচ্ছে বা করলা ব্যবহার করা হয় না। বালসামিক ভিনেগার তৈরির মূল উপকরণ হচ্ছে আঙুরের রস। দারুণ সুগন্ধযুক্ত এই ভিনেগার মূলত ইতালি থেকে ধীরে ধীরে সারা বিশ্বে পৌঁছেছে । বালসামিক ভেষজ গুণসম্পন্ন ভিনেগার। তাই সারা বিশ্বেই এর চাহিদা। তবে এটি তৈরিতে দীর্ঘ সময় ও বাছাই করা উপকরণের কারণে এর মূল্য খুব বেশি।
? রাইস ভিনেগার
বিভিন্ন প্রকার শস্যদানা থেকে নানা রকম ভিনেগার তৈরি হয়। তবে এর মধ্যে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে ধানের চাল থেকে তৈরি ভিনেগার, যা রাইস ভিনেগার নামে পরিচিত।
পোল্ট্রি খামার ব্যবস্থাপনায় ভিনেগারের ব্যবহার খুবই সুফল বয়ে এনেছে।।লিভার টনিক ও ভেষজের সংমিশ্রনে এন্টিবায়োটিক হিসেবে ও দারুন ভূমিকা পালন করে।
? আপেল সিডার ভিনেগার ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী উপাদানের কারণে সুপরিচিত। এই কারণে পোল্ট্রির মলে দুর্গন্ধ দূর করতে আপেল সিডার ভিনেগার চমৎকার কাজ করে।
? ভিনেগার প্রাকৃতিক পরিষ্কারক হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। এর কারণ হচ্ছে, এর ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী উপাদান।তাই বেক্টেরিয়াল ইনফেকশন প্রতিরোধ ও দূর করতে পানিতে ভিনেগার মিশিয়ে খাওয়ানো একটি কার্যকরী ব্যবস্থা।(২চা চামুচ ১ লিটার পানিতে)।পানিতে ভিনেগার মিশিয়ে স্প্রে করলেও খামারে ব্যকটেরিয়া দূর করা যায়।
? ভিনেগার খামারের কিট পতঙ্গ মারার ফাঁদ হিসেবে খুব সহজে ব্যবহার করা যায়।মশা মাছি থেকে পরিত্রাণ পেতে ভিনেগার পানিতে মিশিয়ে খামারেস্প্রে করলে মশা মাছি দূরে থাকবে। এবং পরিবেশ সুন্দর রাখবে।
? পোল্ট্রির জন্য শাক-সবজি বিষমুক্ত করতে ভিনেগার ব্যবহার করা যায়।এছাড়া খাবারের বিপজ্জনক ব্যাকটেরিয়া দূর করে ভিনেগার।উদাহরণ স্বরূপ, ভিনেগার দিয়ে ধৌত করা খাবার থেকে ইকোলাই এবং সালমোনেলার মত বিপদজনক ব্যাকটেরিয়া দূর করা সম্ভব।
? ভিনেগার লিভার টনিক হিসেবে ব্যাপক কাজ করে।এবং এযে থাকা এন্টিঅক্সিডেন্ট পোল্ট্রির কোষ সুরক্ষিত করে।(সুপার লিভার টনিক =১চা চামুচ ভিনেগার+১চা চামুচ কালোজিরা ১লিটার পানিতে)।
? নিয়মিত ভিনেগার বা সিরকা ব্যবহারে পোল্ট্রির পেট ফোলা ও হজম না হওয়া দূর করে ও হজমে সহায়তা করে।
? ভিনেগার বা সিরকা কিছু অ্যান্টিবায়োটিকাল গুণ রয়েছে। অনেক আগে থেকেই প্রচলিত যে, আপেল সিডার ভিনেগারে রয়েছে পেকটিন, যা বাস্তবিকই পোল্ট্রির অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধান করে। ২চা চামচ আপেল সিডার ভিনেগার ১লিটার পানিতে মিশিয়ে পোল্ট্রিকে খাওয়াতে হবে।
? ভিনেগার বা সিরকা পোল্ট্রির শরীরের রক্ত প্রবাহ সচল এবং রক্তে অক্সিজেন প্রবাহ বাড়ায়। এ ছাড়াও পোল্ট্রির শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্লান্তি দূর করে ও প্রাণবন্ত রাখে।
? ভিনেগার বা সিরকাতে এন্টিবায়োটিক থাকায় যেকোন রকমের ক্ষত বা ফাঙ্গাল ইনফেকশন ,গুটি বা ফুসকুড়ি দ্রুত সেরে ওঠে।
? ভিনেগারে চর্বি, কার্বোহাইড্রেটের মতো উপাদান নেই। এর বদলে পানির পরিমাণ থাকে সবচেয়ে বেশি। তাই পোল্ট্রির শরীরের জন্য উপকারীই বটে।
ভিনেগারের সাথে অন্যান্য ভেষজের সংমিশ্রন
ভিনেগার➕মধু
ভিনেগার➕কালোজিরা
ভিনেগার➕হলুদ
ভিনেগার➕রসুন
♻️ প্রতি লিটারে ১চা চামুচ ভিনেগার+১চা চামুচ উল্লেখিত ভেষজ।
⚠️⚠️ সতর্কীকরণ⚠️⚠️ টিকা দেওয়া কালীন সময়ে ভিনেগার ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে।(কম পক্ষে ৩ দিন)।অতিরিক্ত মাত্রা প্রোয়গ থেকে বিরত থাকতে হবে,,নয়তো বিপদ হতে পারে।
⚗️⚗️ঘরোয়া পদ্ধতিতে ভিনেগার প্রস্তুতকরুন ⚗️⚗️ —–
উপকরন:
১) ক্যামিক্যাল বিহীন তাজা আপেল কুচি কুচি কিউব।
২) পরিস্কার পানি। (২৪০ মি.লি. পানি, ১ টেবিল চামচ = ১৫ মি.লি./গ্রাম চিনির মিশ্রন)।
৩) ১টি গ্লাস জার।
প্রস্তুত প্রক্রিয়া:
১) কাচের জারের ৩/৪ (৭৫%) আপেল কিউব দিয়ে পরিপূর্ণ করতে হবে।
২) পানি ও চিনির মিশ্রন মিশাতে হবে আপেল কিউব পানিতে ঢেকে না যাওয়া পর্যন্ত।
৩) পরিস্কার কাপর দিয়ে মুখ বেধে ১৪ দিন উষ্ণ ও অন্ধকার স্থানে রাখতে হবে।
৪) প্রতিদিন একবার আলোরিত/ঝাকাতে হবে। জারের উপরের অংশে কোন বাদামি/ধুসর রংয়ের কিছু জমলে তা তুলে ফেলে দিতে হবে।
৫) ২ সপ্তাহ পর আপেল কিউবগুলো তুলে ছেকে নিন তারপর এটিকে ১৪-২৮ দিন উষ্ণ ও অন্ধকার স্থানে রাখতে হবে।
৬) এখন এটিকে ফিল্টার পেপারে ছেকে নিন, তৈরী হয়ে গেল ফ্রেশ আপেল সাইডার ভিনেগার।
৭) এটিকে আপনি যতদিন ইচ্ছা ফ্রিজে সংরক্ষণ করতে পারেন। আর যদি ফ্রিজের বাইরে বতলে ভরে সংরক্ষণ করতে চান তাহলে এতে ৫% “এসেটিক এসিড” নিশ্চিত করতে হবে।
? Joya K ahmed