বাংলা বাঘের ব্যাকরণ”
পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে যাদের চোখে পানি আসেনা তাদের হৃদয় নেই, বলেছিলেন কোন এক রান্নাঘরের দার্শনিক। কিন্তু বাঘ বলতে যাদের মনের কোণে একটুও ভয়ের উদ্রেক হয় না, তাদের অনুভূতিই পাথর হয়ে গেছে বলা যায়।
হুম, এই সেই বাঘ যা আমাদের সাহিত্য, সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য নিয়ামক। বাংলা প্রবাদ, “মাঘের শীতে বাঘ কাঁপে” বা “ আউলে (অস্থির) বাঘ জালে পড়ে” থেকে শুরু করে রুপকথার গল্পে, “ বোকা বাঘ ও চতুর শেয়ালের” সেই কাহিনী, সব কিছুতেই রয়েছে তার সরব উপস্থিতি।
কিছু কথা বলব এই বনের রাজা বাঘ নিয়েই, তার একটা কারণ ও অবশ্য আছে। আর তা হল, আজ ২৯ শে জুলাই, বিশ্ব বাঘ দিবস।
বিশ্বের এক সময় ৯ উপপ্রজাতির বাঘ পাওয়া যেত যার ৩ টিই এখন বিলুপ্ত। যে ৬ টি উপপ্রজাতি এখনো টকে আছে সেগুলো হল, বেঙ্গল, সাইবেরিয়ান, মালায়ান, সাউথ চাইনিজ, ইন্দো চাইনিজ এবং সুমাত্রান যার সব কটিই এখন বিলুপ্তির মুখে। এদের মাঝে সাইবেরিয়ান বাঘ হল সব থেকে বড় আর দ্বিতীয় সর্ব বৃহৎ বাঘ হল আমাদের ঐতিহ্যবাহী রয়েল বেঙ্গল টাইগার।
কিন্তু বাংলার নামে নামাঙ্কিত সেই রয়েল বেঙ্গল টাইগার আজ হুমকির মুখে। বাংলাদেশ বোন বিভাগের হিসেবে ২০০৪ সালে বাংলাদেশে বাঘের সংখ্যা ছিল ৪৪০ টি যা সর্বশেষ ২০১৫ সালের হিসেব অনুসারে কমে নেমে এসেছে ১০৬ এ। তার চেয়েও দুঃখজনক সত্য হল বাঘ সংরক্ষণে বাংলাদেশ সহ অন্যান্য দেশ একই সংগে ব্যবস্থা নিলেও সকল দেশে বাঘের সংখ্যা বাড়লেও একমাত্র বাংলাদেশেই তার উল্টো ঘটনা ঘটেছে। আর সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা কমার কারণ হিসেবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা চারপাশে শিল্প কারখানা স্থাপন, বনের ভিতর দিয়ে নৌযান চলাচল, চোরা শিকারিদের দ্বারা বাঘ শিকার ও জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করেছেন।
শুধুমাত্র পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় নয়, আমাদের এই ঐতিহ্য কে টিকিয়ে রাখতে বেঙ্গল টাইগারকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদেরই। আর সেজন্য এর সম্পর্কে জানা জরুরী। চলুন, জেনে নেই রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সাতকাহন।
প্রথমে জেনে নেই বেঙ্গল টাইগারের প্রাথমিক কিছু তথ্য –
পুরো নামঃ রয়েল বেঙ্গল টাইগার
বৈজ্ঞানিক নামঃ Panthera tigris tigris
গায়ের রঙঃ পেটের দিকে হলুদ থেকে হালকা কমলা রঙ যা পায়ের দিকে গিয়ে সাদা বা ক্রিমের মত হয়ে গিয়েছে। আর উল্লম্বভাবে কালো, ধূসর বা বাদামী রঙের ডোরা কাটা দাগ রয়েছে লেজ অবধি।
দৈর্ঘ্যঃ বাঘ- ১০৬-১২২ ইঞ্চি, বাঘিনী – ৯৪-১০৪ ইঞ্চি (লেজ সহ)। শুধু লেজের দৈর্ঘ্য- ৩৩-৪৩ ইঞ্চি।
ওজনঃ বাঘ- ৪০০-৫৫০ পাউন্ড, বাঘিনী- ২২০-৩৫৩ পাউন্ড।
বিস্তৃতিঃ ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান। চীন ও মায়ানমার এও আছে বলে ধারনা করা হয়।
সংখ্যাঃ বাংলাদেশ-১০৬, ভারত-২২২৬, নেপাল-১৯৮, ভুটান- ১০৩ (সরকারী সুত্র-২০১৬)
খাবারঃ গাউর, মহিষ, শূকর, সাম্বার, চিতল বা অন্যান্য জাতের হরিণ। কখনো কখনো খরগোশ, সজারু এবং গৃহপালিত পশু। বেঙ্গল টাইগার একসাথে ৪০ কেজি পর্যন্ত খাবার খেতে পারে যদিওবা তারা সবসময় এর থেকে কমই খায়।
প্রাপ্তবয়স্কঃ বাঘ; ৪-৫ বছর, বাঘিনী; ৩-৪বছর।
প্রজননঃ ২-৩ বছরে একবার, বাচ্চা সংখ্যা ৩-৫ টা।
গর্ভকালঃ ১০৪-১০৬ দিন।
আয়ুস্কালঃ ১৫-২০ বছর।
এবার জানবো বেঙ্গল টাইগার ও অন্যান্য বাঘের কিছু বিস্ময়কর তথ্য-
১। বেঙ্গল টাইগারের গায়ে যে ডোরাকাটা দাগ রয়েছে তার ধরন মানুষের আঙুলের ছাপের মত, কারো সাথে কারো মিলে না।
২। বেঙ্গল টাইগারের ছেদন দাঁত(Canine teeth) ৪ ইঞ্চি মাপের যা অন্যান্য বিড়াল জাতীয় প্রাণীদের মধ্যে বৃহত্তর।
৩। বাঘেদের রাতে দেখার ক্ষমতা মানুষের থেকে ৬ গুন বেশী।
৪। তাদের সীমানা চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে তারা তাদের মূত্র ও গাছে নখরের দাগ ব্যবহার করে।
৫। বাঘের মগজের ওজন ৩০০ গ্রাম যা মাংসাশীদের মাঝে বৃহত্তর বলে ধারনা করা হয়।
৬। বাঘের লাল তে এন্টিসেপ্টিক উপাদান রয়েছে যেজন্য তারা তাদের ঘা চাটে যাতে করে জীবাণু ধ্বংস হয়।
৭। বাঘেরা মুত্রের গন্ধ নিয়েই অন্য বাঘের লিঙ্গ, বয়স ও প্রজনন অবস্থা অনুমান করতে পারে।
৮। বাঘেরা সাধারনত অন্য প্রাণীর জন্য গর্জে না। দূরের অন্য কোন বাঘের সাথে যোগাযোগ করতেই মূলত গর্জন করে।
৯। জন্মের প্রথম ১ সপ্তাহ বাঘের বাচ্চারা সম্পূর্ণ অন্ধ থাকে।
১০। মানুষ না খেতে পেলে ৩০-৪০ দিনে মারা যায় কিন্তু বাঘেরা ২-৩ সপ্তাহেই মারা যায়।
১১। বাঘের স্মৃতিশক্তি মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর থেকে অনেক গুণ শক্তিশালী।
১২। বাঘেরা বাঘিনী ও শাবকের যত্ন সম্পর্কে খুবই সচেতন। যার প্রমাণ মেলে কোন শিকারের পর তারা বাঘিনী ও শাবকদের আগে খেতে দেয় যা সিংহের ক্ষেত্রে উল্টো।
আজ বিশ্ব বাঘ দিবসে চলুন নিজে সতর্ক হই ও অন্যকে সতর্ক করি, আমাদের এই জাতীয় সম্পদকে টিকিয়ে রাখতে জোর গলায় আওয়াজ তুলি, “Save the Tigers”.
collected