Breaking News

বন্য প্রাণি দিয়ে কবিরাজি, আমরা সবাই রুখতে রাজি (ডা. নাজমুল হুদা ।)


বন্য প্রাণি দিয়ে কবিরাজি, আমরা সবাই রুখতে রাজি

ডা. নাজমুল হুদা ।

অনেক বন্য প্রাণি/পাখির দেহেই ভেষজ গুনাবলী সম্পন্ন উপাদান রয়েছে । অনেক ক্ষেত্রে তা গবেষণায় ও প্রমাণিত হয়েছে । কোন কোন ক্ষেত্রে কুসংস্কার কীংবা জনশ্রুতির উপর নির্ভর করে ব্যবহৃত হচ্ছে মানুষের চিকিৎসায় বন্য প্রাণির অংগ প্রত্যংগ । এজন্য প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে ধরা হচ্ছে বন্য প্রাণি পাখি যা জীববৈচিত্র সংরক্ষনের মারাত্নক হুমকিস্বরুপ । উদাহরণ হিসাবে হায়েনা এবং সিংহের চর্বি পেটের ব্যাথা নিরাময়ে কার্যকরী (সুদানিজ ট্রেডিশনাল মেডিসিন), কুমিরের (কাল কাইমেন) রক্ত মৃগি ও স্ট্রোক এর রোগীর চিকিৎসায় কার্যকর , বাঘের পেনিসের সুপ যৌন শক্তি বর্ধক ইত্যাদি । এইগুলির কোন গবেষণা প্রতিবেদন নাই শুধুই কবিরাজি । ট্রেডিশনাল মেডিসিন এ বন্য প্রাণির অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ব্যবহার এখনও প্রচলিত আছে এশিয়া, আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকায় ।

০৮ মে ২০১৯ । বেলা আনুমানিক সাড়ে এগারোটা । অফিস কক্ষে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিভিএম ইন্টার্ণিদের একটা সেশন পরিচালনা করছি । এর মধ্যে ডা. পারভিন মুর্শিদার ফোন ।
স্যার , আসসালামু আলাইকুম ।
” ওয়ালাইকুমুস সালাম ।
স্যার কি অফিসে আছেন?
” হ্যাঁ অফিসে আছি ।
স্যার দয়া করে নেট এর আওতায় আসেন । আমি কয়েকটা প্রাণির ছবি দিচ্ছি ম্যাসেঞ্জারে । প্রজাতি শনাক্ত করা প্রয়োজন ।

ডা. পারভিন মুর্শিদা একজন ভেটেরিনারিয়ান । পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিভিএম ডিগ্রী অর্জন করে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভেটেরিনারি প্যাথলজিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেছেন । ডিভিএম ইন্টার্ণশীল চলাকালীন সময়ে আমার হাতে ওয়াইল্ডলাইফ মেডিসিনের উপর ঠুটা-ফাটা দীক্ষা তিনি গ্রহণ করেছেন , সেই সুবাদে আমি তাঁর গুরু । এদিকে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে লাইভস্টক এক্সটেনশন অফিসার (এল.ই.ও) পদে চাকুরি করার কারণে আমার সহকর্মীও বটে । তাঁর কর্মস্থল খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলায় । ডুমুরিয়া উপজেলার কোন একজন বাজারে এক কবিরাজ সান্ডার তেল বিক্রি করছিল । সান্ডার তেল বিক্রির সময় এই প্রাণিটি হাতে করে সে দেখাচ্ছিল যে এই প্রাণিটির চর্বি থেকে সান্ডার তেল তৈরী হয় । গুনাগুন হিসাবে বর্ণনা করছিল ” এই তেল মালিশে মাংস পেশীর ব্যাথা, জয়েন্টের ব্যাথা নিরাময় হয়, পুরুষের পুরুষালী বৃদ্ধি করে ইত্যাদি ।” বন্য প্রাণি সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন (সংশোধিত) ২০১২ মোতাবেক ইহা শাস্তিযোগ্য অপরাধ । তাই পুলিশ প্রাণি দুইটি জব্ধ করে এবং কবিরাজকে থানায় নিয়ে আসে । প্রাণির বিবরণ লেখার জন্য প্রজাতি শনাক্তকরণের প্রয়োজন হয় । তাই প্রাণিগুলি নিয়ে আসা হয়েছিল উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতালে , ডুমুরিয়াতে ।

এই প্রাণিটিকে Sanda Lizard বা সান্ডা গিরগিটি বলা হয় । পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের লাহোর জেলার একটি টাউনের নাম সান্ডা । সান্ডা অঞ্চলে এগুলির আধিক্যতার কারণে পাকিস্তানে ইহা Sanda গিরগিটি নামে পরিচিত । সরীসৃপ জাতীয় প্রাণিটির ইংরেজি নাম ইন্ডিয়ান স্পাইনি টেইলড লিজার্ড (Indian Spiny Tailed Lizard) /হার্ডউইকস স্পাইনি টেইলড লিজার্ড ( Hardwick’s Spiny Tailed Lizard) । ট্যাক্সনোমিক্যালি প্রাণিটির বিন্যাস দাড়ায় –
Kingdom- Animalia, Phylum- Chordata, Class- Reptilia , Order- Squamata, Family-Agamidae, Sub family- Uromastycinae , Genus – Saara /Uromastyx ,

প্রাণিটির বৈজ্ঞানিক নাম Saara hardwickii অথবা Uromastyx hardwickii .
মাথা গোলাকার এবং স্নট চ্যাপ্টা । গায়ের রং হলুদাভ বাদামী, ধূলার রং অথবা জলপাই রঙ্গের হয়ে থাকে । দেহের উপর থেকে নিচের দিকে চ্যাপ্টা এবং চামড়া ভাঁজ পরা, ঢিলেঢালা । লেজের মধ্যে কাটাযুক্ত স্কেল বিদ্যমান এবং কিনারায় বেশী । স্কেলগুলি সারি আকারে বিন্যস্ত । শীতের সময়ে গায়ের রং গাঢ় হয় । পুরুষ প্রাণির দৈর্ঘ ১৬-১৯ ইঞ্চি এবং স্ত্রী প্রাণির দৈর্ঘ্য ১৩-১৬ ইঞ্চি । দৈহিক ওজন ১০০-৪০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে । তুলনামূলকভাবে শক্ত মাটিতে থাকতে পছন্দ করে । ২.৫- ৩ ইঞ্চি ডায়ামিটারের টানেল তৈরী করে যার সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য ৬.৬ ফুট হতে পারে । শীতকালটা শীতনিদ্রায় কাটায় এবং বসন্তের শুরুতে বের হয় । বর্ষাকালে গর্তের বাইরে থাকে মেরুদন্ডের দুইপাশে এবং লেজে চামড়ার নিচে মোটা একটা চর্বির লেয়ার জমায় শীতনিদ্রায় শক্তি সঞ্চয় করার জন্য । মূলত তৃণভোজি তবে কীট পতঙ্গও এরা ভক্ষন করে ।

প্রাপ্তিস্থান : এদেরকে ভারতের রাজস্থান ,গুজরাট, উত্তর প্রদেশের শুষ্ক এবং মরুময় অঞ্চলে , পাকিস্তানের পাঞ্জাব এবং আফগানিস্তান-পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী অঞ্চলসমূহে পাওয়া যায় । বাংলাদেশে সান্ডা লিজার্ড পাওয়া যায় না । ধারণা করা হচ্ছে যশোহরের বেনাপোল কীংবা সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে বাংলাদেশে চোরাচালানীদের মাধ্যমে প্রবেশ করেছে ।

যেভাবে সান্ডা গিরগিটি ওষুধ তৈরীতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে –
প্রাচীন ভারতীয় ফার্মাকোপিয়া আয়োর্বেদ এ এই প্রাণির অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ব্যবহারের প্রমাণ মিলেছে । সেক্ষেত্রে কিছু ভেষজ গাছ গাছরার নির্যাসের সাথে সান্ডার তেল মিশ্রণ করে ফর্মুলা তৈরী করা হয়েছে এবং সান্ডা ওয়েল নামে প্যাটেন্ট হয়েছে । রাজস্থান এবং পাঞ্জাবে বাংলার ভাওয়ালী/ মাওয়ালীদের মত একটা কমিউনিটি আছে যারা জীবিকার জন্য নির্ভর করে এই নিরীহ প্রাণিটির উপর । গর্তবাসী এই প্রাণির গর্ত থেকে তারা গর্ত কেটে লেজ ধরে টেনে বের করে নিয়ে আসে শীতকালে । সংগ্রহ করাকালীন সময়ে ভার্টিব্রাল কলাম ভেঙ্গে দেয় যাতে পালিয়ে যেতে না পারে । Crude পদ্ধতিতে প্রাণিটিকে জবাই করে চর্বিটা সংগ্রহ করে । একটা প্রাণি থেকে ১৫ চা চামচ পর্যন্ত তেল তৈরী করতে পারে । ছোট ছোট শিশিতে করে তেল বিক্রি করে । আর কিছু সান্ডা প্রদর্শণিতে রাখে । অর্ডার বেশী পেলে তাৎক্ষনিক তৈরী করে দেয়ার ব্যবস্থাও তারা রাখে । April ২০১৮ সালের ২ এপ্রিল পাকিস্তানের The Frontier Post
পত্রিকায় এতদসংক্রান্ত বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন ছাপানো হয়েছে । Sanda তেলের যে ভেষজ ক্ষমতা বলে বিক্রি করা হচ্ছে তার কোন গবেষণা রিপোর্ট নাই যেমনটি কস্তুরির বেলায় আছে । যেহেতু সরীসৃপ শীত নিদ্রায় যায় তারা চামড়ার নিচে চর্বি সঞ্চয় করে রাখে । সান্ডা ছাড়াও অন্য সরীসৃপের শরীর থেকেও তেল সংগ্রহ করা যাবে । সান্ডা ব্যবসায়ীরা যখন সান্ডাকে পাবেনা তখন সমগোত্রীয় সরীসৃপগুলিকে ধ্বংশ করবে ।

এক পাষন্ডের দল সান্ডা মেরে ঠান্ডা করছে আর অজ্ঞের দল অন্ধ বিশ্বাসে তা ব্যবহার করছে । যে প্রাণিটির মেরুদন্ড ভেঙ্গে নীরব রেখে আস্তে আস্তে মারছে তার শরীরে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি থাকা খুবই স্বাভাবিক । ফলে হিতে বিপরীত হতে পারে । অতএব সাবধান -সান্ডার তেল হতে ।

“The use of spiny-tailed lizards Uromastyx spp. for medicinal
purposes in Peninsular Malaysia” শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে মালয়েশিয়ার একদল বিজ্ঞানী লোমহর্ষক তথ্য দিয়েছেন । পাক ভারত উপমহাদেশে Saara Hardwickii সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে । কিন্তু মালয়েশিয়াতে ট্রেডিশনাল মেডিসিন শপে প্রায় ২০ প্রজাতির Uromastyx Sp এর চামড়া, তেল এবং মাংসের গুড়া যা কফির সাথে মিক্স করে বাজারজাত করা হচ্ছে ।
নিরীহ এই প্রাণিগুলি পরিবেশের বায়েলজিক্যাল পেস্টিসাইড হিসাবে কাজ করে । এদের সংখ্যা কমে গেলে বা বিলুপ্ত হয়ে গেলে সংশ্লিস্ট ইকোসিস্টেমে আরেক দফা Vector Borne ডিজিজ বৃদ্ধি পাবে ।

আমাদের দেশের কবিরাজরা সেই ব্রিটিশ আমল থেকে কবিরাজিতে সান্ডার তেল ব্যবহার করছে । প্রতিবেশী দেশগুলিতে তাদের ওয়াইল্ডলাইফ প্রিজারভেশন এক্ট এর মাধ্যমে সান্ডাকে প্রটেকশন দিয়েছে । আন্তর্জাতিক ট্রেড এর ক্ষেত্রে সাইটিস এপেন্ডিক্স-২ এর আওতাভূক্ত সান্ডার ট্রেড । সান্ডা না পেলে অন্যান্য সরীসৃপগুলি তাদের খপ্পরে পরতে পারে । তাই বন্য প্রাণি দিয়ে কবিরাজি আমরা সবাই রুখতে রাজি । সান্ডাকে কোন কবিরাজের কাছে দেখলেই আমার আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী কীংবা ওয়াইল্ডলাইফ ক্রাইম কন্ট্রোল ইউনিটকে অবহিত করতে পারি ।

Please follow and like us:

About admin

Check Also

জলহস্তী এবং ওয়ারলাস পরিচিতি

বড়ই রেসিস্ট জাতি আমরা। একটু মোটা বন্ধু দেখলেই এই Hippo বলে মজা নেই। Hippo বা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Translate »