পোল্ট্রি ফার্মিংঃ আত্নকর্মসংস্থান নাকি আত্ন বলিদান ?
প্রথম পর্বঃ
আত্নকথাঃ
পোল্ট্রি সেক্টর নিতান্তই অবহেলিত একটি সেক্টর। বিগত তিন দশকে এই সেক্টরের অনেক উত্থান পতনের মাঝে দিয়ে অতিবাহিত হলেও পোল্ট্রি সেক্টরের উদ্বমুখী গতি কখনই থেমে থাকে নি। হোচট খেয়েছে বারবার , কিন্তু বরাবরই দুর্দান্ত প্রান চাঞ্চল্য বালকের ন্যায় আবার পুনরুদ্দোমে এগিয়ে চলেছে। হাজারো লাখো কর্মহীন ,শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত বা অশিক্ষিত, নারী বা পুরুষ, বয়ষ্ক কিংবা যুবক , শহুরে কিংবা গ্রামিন সকলের কর্মসংস্থানের ব্যাবস্থা করেছে। স্বপ্ন যুগিয়েছে হাজারো তরুনকে অল্প বয়সেই লাখপতি হবার , প্রেরনা দিয়েছে গ্রামের অসহায় সঞ্চয়হীন পরিবারটিকে আয় রোজগারে সয়ংসম্পূর্ন হবার। বিনা পুজিতে কিংবা যতসামান্য পুজিতে খামার করার সুযোগ ,গ্রামীন গরিব দুঃখী, জমিজমা বিহীন খেটে খাওয়া মানূষ গুলোকে দিয়েছে সামাজিক ভাবে আত্নসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকের উপায়।
বলছিলাম গ্রামীন গরিব চাষিদের মুরুগীর খামারী হয়ে উঠার কথা। ছোট বেলায় ডিম, মুরগী দুটোই খেয়েছি আজও খাচ্ছি । পার্থক্য একটাই যে, ছোটবেলার সেই মুরগী বা ডিম তৈরিতে ছিলনা কোন বিনিয়োগ, ছিলনা মুরগী প্রতিপালনে খাবার বা মেডিসিন ভ্যাক্সিনের খরচ , ছিলনা কারো কর্মসংস্থানের সুযোগ, ছিলনা তেমন কোন বারতি আয় রোজগারের পথ। প্রায় সকল বাড়িতেই হাস মুরগী প্রতিপালন হতো।
অথচ ভাবা যায়! আজকের এই ডিম বা মুরগী উৎপাদনের পিছনে পঞ্চাশ লক্ষেরও অধিক লোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে জড়িত। এদের একটা বড় অংশ গ্রামীন অর্থনৈতিক উন্নয়নে ক্রমাগত অবদান ্রেখে যাচ্ছে।
প্রত্যন্ত গ্রামের সুযোগ সুবিধা বঞ্চিচ মানুষগুলোও ডিম,মুরগীর মংস খেতে পারছে তার ক্রয় ক্ষমতার মধ্যেই। আজ অব্দি বাংলাদেশের কোন যায়গায় এমন কোন পরিবেশ তৈরি হয়নি যে, কেউ ডিম বা মুরগি ক্রয় করতে গিয়েছে অথচ বাজারে ঘাটতি রয়েছে আর সে খালি হাতে ফিরে এসেছে। আবার এর উল্টোটাও ঘটেনি যে, ডিম মুরগী বিক্রয় করতে না পেরে সেগুলো নষ্টকরে ফেলতে হয়েছে। বরং এটা অনেকবার ঘটেছে যে, একজন খামারী তার পন্যের ন্যায্য মুল্য না পেয়ে বহুবার সর্বসান্ত হয়েছে , কিন্তু এর পরেও আমিষের যোগান দিয়েই যাচ্ছে।
ভাববার বিষয়, ৩০-৩৫ দিন ব্রয়লার প্রতিপালনে বা ৪ মাস লালনপালনের পর প্রতিদিন ডিম উৎপাদনের পিছনে একজন খামারী কতগুলো লোকের জীবিকার ব্যাবস্থা করছে। ভুট্টা উৎপাদনকারী কৃষক থেকে শুরু করে ভুট্টা ফিডমিলে পৌছানো পর্যন্ত সাপ্লাই চেইনে জড়িত দিনমজুর,ডিলার,আরতদার,ট্রান্সপোর্ট ব্যাবসায়ী ,ড্রাইভার সকলেই এখান থেকে আয় করছে। এটাতো শুধু একটি উদাহারন যা মুরগীর খাদ্য তৈরিতে ২০-২৫ টি উপাদানের একটি মাত্র উপাদান। ঠিক তেমনি ভাবে প্রতিটি উপাদানের সাপ্লাই চেইনে জড়িত সকল মানুষ একজন খামারীর ডিম বা মুরগী উৎপাদনের প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবারহের পিছনে আয় করছে। আবার বাচ্চা সরবারহের পিছনে সেই সুদুর ইউরোপ থেকে আনিত গ্র্যান্ড প্যারেন্ট থেকে প্যারেন্ট, প্যারেন্ট থেকে হ্যাচারীর মাধ্যমে বাচ্চা উৎপাদন ও সরবারহ, মেডিসিন কিংবা ভ্যাক্সিন,খামারের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, মধ্যাকথা ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ এর সকলেই প্রতিটি গরিব খামারীর ডিম বা মাংস উৎপাদনে যেমন সহযোগিতা করছে তেমনি এর থেকে আয়ও করছে। আবার ফরওয়ার্ড লিংকেজ এ ডিম বা মুরগি খামারির কাছ থেকে ভোক্তা পর্যন্ত পৌছানোর সাথে জড়িত সকলেই আয় করছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো এত সংখ্যক কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েও, এত বড়ো সাপ্লাই চেইনে সকলকে মুনাফা দিয়েও ভোক্তার কাছে সহনীয় মুল্যে আমিষের যোগান দিয়ে যাচ্ছে এই ক্ষুদ্র প্রান্তিক খামারীরা।
বিগত তিন দশকে হাজারো খামারীর স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে, হাজারো খামারী নিঃস্ব হয়েছে আর সকল পুজি হারিয়েছে,হাজারো খামারীকে ঋনের বোঝা বয়ে বেড়াতে হচ্ছে, অসংখ্য খামারীকে তার খামার বন্ধ করে দিতে হয়েছে,এমনকি আত্নহত্যার মত ঘটনাও ঘটেছে পাওনাদারের টাকা না দিতে পারায়। কিন্তু এতবড় সাপ্লাই চেইনের অন্য কোন অংশকে বা অন্য কাউকে এমন কোন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় নি। হ্যা হয়তো ব্যাবসায়িক ক্ষতি হয়েছে সাময়িক কিন্তু এর চেয়ে বেশি আয়ের সুযোগ তাদের আবার তৈরী হয়েছে।
অত্যন্ত আক্ষেপের বিষয় হলো এই প্রান্তিক খামারীদের উপর ভর করে গড়ে ওঠা এই পোল্ট্রি সেক্টরের (যা আজ শিল্পে পরিনত হয়েছে) প্রায় সকলেই অবমুল্যায়ন করেছে।যে খামারিরাই অনেককে শিল্পপতি বানিয়েছে,হাজার কোটি টাকার মালিক বানিয়েছে ,তাদের নুন্যতম টিকে থাকার ব্যাবস্থা করতে পারে নি তথাকথিক পোল্ট্রি শিল্পপতিরা। তারা নেতৃত্ব দিয়েছে জাতীয় ভাবে,নিজেদের সকল সুবিধা আদায় করে নিয়েছে,কিন্তু গরীব খামারিদের সুবিধাবঞ্চিত করেছে। তারা পারেনি কোন বাজার ব্যাবস্থা তৈরি করতে, যেখানে খামারীরা নায্য মুল্য পাবে,তারা পারেনি কোন ট্রেনিং ইন্সটিটিউট তৈরি করতে, যেখানে পোল্ট্রিজ্ঞ্যানহীন খামারীরা জ্ঞ্যান লাভ করবে, তারা পারেনি কোন ডেমন্সট্রেশন ফার্ম করতে,যেখানে খামারীরা হাতে কলমে শিখতে পারবে। এমনকি অত্যান্ত পরিভাবের বিষইয় যে, তারা নিজেদের উৎপাদিত বাচ্চার দামটাও নিয়ন্ত্রন করতে পারেনি, ফলে ৩০ টাকার বাচ্চার দাম যেমন ১০০ টাকা হয়েছে আবার তা ৫ টাকাতেও বিক্রয় করতে হয়েছে। তারা ব্যার্থ হয়েছে এই প্রান্তিক খামারীদের টিকিয়ে রাখার ব্যাবস্থা করতে। আর এর ফলাফল আজ সবাই মিলে ভোগ করছে।
কঠিন ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে এই পোল্ট্রি সেক্টর। এই ক্রান্তিকালে পোল্ট্রির সাথে জোড়িত সকলে আজ অস্তিত্ব সংকটে পরেছে।
এই পরিস্থিতি উত্তোরন হবে,কিন্তু আমাদেরকে অবশ্যই এর থেকে শিক্ষা নিতে হবে। (চলবে)
Md. Mahmudul Hasan
Business Development Manager
Nourish Poultry & Hatchery Ltd.