তুষ_হারিকেন_পদ্ধতিতে_হাঁসের_ডিম_ফুটানোঃ
কৃত্তিম উপায়ে হাঁসের ডিম ফুটানোর জন্য তুষ-হারিকেন পদ্ধতি একটি জনপ্রিয় পদ্ধতি। সাধারণত হ্যাচারী মালিকগণ জানুয়ারী থেকে এপ্রিল পর্যন্ত হাঁসের ডিম বেশী ফুটানো হয়। অনেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডিম ফুটায় তবে নভেম্বর থেকে জানুয়ারী পর্যন্ত হ্যাচারী বন্ধ রাখে। ময়মনসিংহের নান্দাইল, কিশোরগঞ্জের তারাইল, নেত্রকোনার কেন্দুয়া-মদন সহ এইসব এলাকার বিভিন্ন জায়গায় হাঁসের বাচ্চা উৎপাদন করা হয়। এসব এলাকা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্হানে স্বল্প পরিসরে বাচ্চা উৎপাদন করা হয়। এসব উৎপাদিত বাচ্চা এখানকার হাওর এলাকার (নেত্রকোনা-কিশোরগঞ্জ) খামারীদের কাছে বিক্রয় হয়। এছাড়াও টাঙ্গাইল, রাজশাহী, বগুড়া, কুমিল্লা, সাভার, গাজীপুর, নারায়নগঞ্জ, ফেনী সহ দেশের বিভিন্ন স্হানে সরবরাহ করা হয়।

#প্রয়োজনীয়_জিনিসপত্রঃ
১. তুষ ও হারিকেন, ২. কাঠ ও বাঁশ, ৩. বাঁশের চাটাইয়ের গোলাকার ঝুরি বা সিলিন্ডার (উচ্চতা ৩.৫ ফুট, ব্যাস ২ ফুট), ৪. থার্মোমিটার, ৫. টর্চ লাইট বা এগ ক্যান্ডেলার ৬. চটের ছালা-লেপ-রঙিন কাপড়, ৭. একটি উপযুক্ত ঘর

#জিনিসপত্রের_বিন্যাসঃ
ঘরের মধ্যে বাঁশের সিলিন্ডার বসানোর জন্য কাঠ ও বাঁশ দিয়ে বক্স তৈরি করতে হবে (৫টি সিলিন্ডার বসানোর জন্য দৈর্ঘ্য ৭ফুট ও প্রস্থ ৩.৫ ফুটই যথেষ্ট)। তারপর সিলিন্ডার বসিয়ে তার চারপাশে তুষ দিয়ে ভরাট করে দিতে হবে এবং সিলিন্ডারের মুখ কাপড়-ছালা-লেপ দিয়ে ঢেকে রাখার ব্যবস্থা প্রস্তুত রাখতে হবে। অনেকে সিলিন্ডারের পরিবর্তে বাঁশ-কাঠ-তুষ বিছিয়ে ফ্লোর থেকে ৩.০-৩.৫ ফুট উচ্চাতায় বেড তৈরী করে এবং বেডের নীচে হারিকেন দিয়ে বেডের উপর বিছানো ডিমে তাপ দেয়। ডিমে তাপ সংরক্ষণ করার জন্য লেপ দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। হারিকেনে তেল ভরে ও সলতে লাগিয়ে জ্বালানোর উপযোগী করে রাখতে হবে তথা সিলিন্ডারে ডিম দেয়ার ৩-৪ ঘন্টা আগে হারিকেন সিলিন্ডারে রেখে তাপ (১০০°ফাঃ) তুলতে হয়। ডিম ফুটানোর জন্য তৈরী বক্সের কয়েক ফুট (২.৫-৩.০ ফুট) উপরেই পরিস্ফুটন বিছানা (হ্যাচিং বেড) কাঠ ও বাঁশ দিয়ে তৈরী করে তাতে চাটাই বিছিয়ে তার উপর কিছু তুষ বিছিয়ে তুষের উপর চট ও কাপড় বিছিয়ে তার উপর ডিম রেখে ঢেকে রাখার জন্য কাপড় বা লেপ প্রস্তুত রাখতে হবে। হ্যাচিং বেড আলাদা জায়গায়ও করা যায়। হ্যাচিং বেড একটি করে বা ২-৩ টা তাক করেও প্রস্তুত করা যায়। সিলিন্ডারের ও হ্যাচিং বেডের তাপমাত্রা (১০০°ফাঃ) নিয়ন্ত্রণ/পরিমাপ করার জন্য থার্মোমিটার এবং ডিমের ভ্রুণ পরীক্ষা করে ডিম বাছাই করার জন্য আলোক উৎস টর্চ লাইট বা এগ ক্যান্ডেলার প্রস্তুত রাখতে হয়।

#ডিম_সংগ্রহঃ
খামারীদের কাছ থেকে নিষিক্ত ৫-৭ দিনের ডিমগুলো সংগ্রহ করে হ্যাচারিতে আনা হয়।

#ডিম_বাছাইকরণ_ও_জীবাণুমুক্তকরণঃ
ডিম সংগ্রহের পর ছোট-বড়-ভাঙা ও খারাপ খোসাযুক্ত ডিম ছাটাই করার পর ভাল ডিম (৭০-৭৫ গ্রাম) গুলো রাখা হয়। তারপর ডিমগুলো জীবাণুনাশক দিয়ে (যেমন #ভায়োডিন_ভেট-১০ সলুসন-১মিলি ২ লিটার পানিতে) জীবাণুমুক্ত করে রোদে (২-৩ ঘন্টা বা ১০০°ফাঃ তাপমাত্রা উঠা পর্যন্ত) শুকানো হয়।

#ডিম_বসানোঃ
রোদে শুকানোর পর রঙিন কাপরে ৪০-৫০টি করে ডিম (মোটা অংশ উপরে এবং চিকন অংশ নিচে রেখে) হালকা করে বাঁধা হয়। তারপর সিলিন্ডারে জ্বালানো হারিকেন তুলে সেখানে ডিম বসিয়ে হারিকেন পাশেরটাতে স্থানান্তর করা হয়। আবার ৩-৪ ঘন্টা পর ডিম ও হারিকেন স্থানান্তরকরণ করা হয়। এসময় থার্মোমিটার দিয়ে দেখা হয় তাপমাত্রা ঠিক আছে কিনা। আবার ডিম শরীরে (গালে) লাগিয়েও তাপমাত্রা বুঝা যায়। এভাবে উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে সিলিন্ডারে ডিম ১৫-১৮ দিন পর্যন্ত রাখা হয়। একটি সিলিন্ডারে বা ঝুরিতে সাধারণত ১০০০টি ডিম রাখা যায়।

#এগ_ক্যান্ডেলিং_এবং_বাছাইকরণঃ
৫-৬ দিন পর ডিমে ভ্রুণের উপস্থিতি পরীক্ষা করা হয়। যেগুলোতে সমস্যা থাকে সে ডিমগুলো সরিয়ে ফেলা হয়। এভাবে ঠিক ১১-১২ দিনে আবার পরীক্ষা করা হয় এবং ফাইনালি ডিম ফুটে বাচ্চা হবার উপযুক্ত ডিম গুলো রাখা হয়।

#ডিম_হ্যাচিং_বেডে_স্থানান্তরঃ
১৫-১৮ দিন পর ডিমগুলো হ্যাচিং ট্রেতে স্থানান্তর করা হয় এবং এখানে ১০-১২ দিন রাখা হয়। তারপর ২৮ দিনে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। হ্যাচিং বেডে তাপমাত্রা বেশি হলে ডিম উম্মুক্ত করে রাখা হয় এবং একটু নেরে-চেরে তাপমাত্রা কমানো হয়, আবার তাপমাত্রা কমে গেলে ডিম ঢেকে দেয়া হয়। ডিমের ভিতর যাতে বাচ্চা খোসার সাথে না লেগে যায়, সেই জন্য অনেক সময় পানি ছিটিয়ে আদ্রতা এই সময়ে বাড়ানো হয়।

#ডিম_ফুটে_বাচ্চা_বের_হওয়াঃ
২৭ তম দিনে বাচ্চা পিপিং করে ২৮ তম দিনে ডিম থেকে বের হয়। প্রতি ১০০টি ডিম থেকে ৭৫-৮৫ টি পর্যন্ত বাচ্চা ফুটে থাকে। ডিম খুব ভাল হইলে সর্বোচ্চ ৯০ টি পর্যন্ত ফুটে থাকে।

#বাচ্চা_ব্রুডারে_স্থানান্তরণ_ও_সরবরাহঃ
বাচ্চা ফুটার ১০ মিনিটের মধ্যে বাচ্চা ব্রুডারে নেয়া হয় এবং গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী বাচ্চা গ্রেডিং করে বা পুরুষ ও স্ত্রী বাচ্চা বাছাই করে আলাদা করে সরবরাহ করা হয়। সাধারণত স্ত্রী বাচ্চার দাম পুরুষের চেয়ে ৮-১০ টাকা বেশি হয়। বাচ্চা ফুটার ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত সাধারণত কোনো খাবার দেয়ার দরকার হয় না।

#বাচ্চার_সেক্সিংঃ
যারা পুরুষ ও স্ত্রী বাচ্চা আলাদা আলাদা ক্রয় করতে চান, তাদের জন্য বাচ্চা সেক্সিং করা হয়। প্রতিটি বাচ্চার ক্লোয়েকা চেক করে বাচ্চা সেক্সিং করা হয়। বাচ্চা ধরে তার ভেন্ট পরীক্ষা করে যদি দেখা যায় যে ক্লোয়েকার ভিতর প্যাঁচানো পেনিস আছে, তাহলে সেটি পুরুষ বাচ্চা। আর যেটিতে পেনিস দেখা যাবে না এবং ক্লোয়েকা গোলাপি কালার হবে, তাহলে সেটি স্ত্রী বাচ্চা হবে।

লেখক-
ডাঃ মোঃ আশরাফুল ইসলাম
ডিভিএম, এম এস (মাইক্রোবায়োলজি)